“যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ টাকা নিয়েছেন কর্মপ্রার্থীদের কাছ থেকে কিন্তু কেউ চাকরি পান নি”- এমনই জানিয়েছেন সিবিআইয়ের হেফাজতে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের পলাশীপাড়ার বিধায়ক ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ হুগলির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক তাপস মণ্ডল। তিনি আরও জানিয়েছেন, সিবিআইয়ের কাছে কুন্তল ঘোষ স্বীকার করেছেন তিনি শিক্ষক পদের চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। সংবাদ মাধ‍্যমে তাপস মণ্ডল তাঁর সম্পর্কে এমন মন্তব্য করায় আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন কুন্তল ঘোষের আইনজীবী, কিন্তু তাপস মণ্ডল নিজের বক্তব্যে অনড় রয়েছেন কারণ তাঁর কাছে নাকি “প্রমাণ রয়েছে !” “প্রমাণ” বলতে হাতে লেখা রসিদ যাতে নাকি কুন্তল ঘোষ টাকা নিয়ে সই করেছেন। মানিক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ তাপস মণ্ডল বলেছেন তিনি যদিও কুন্তল ঘোষের উনিশ কোটি টাকা লেনদেনের হিসাব দিয়েছেন আসলে কিন্তু চাকরি বেচা কেনার  লেনদেনের পরিমাণ প্রায় একশো কোটি টাকা।

তাপস মণ্ডলের দাবি সত‍্য হলে মানিক ভট্টাচার্যের মতো কুন্তল ঘোষকেও বিস্তারিত জেরা করার জন‍্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং আর্থিক অপরাধ অনুসন্ধান সংস্থা ই ডি র  নিজেদের হেফাজতে নেওয়া উচিত। কিন্তু তা কতটা সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে কারণ টিভি চ‍্যানেলে এবং অধিকাংশ সংবাদ মাধ‍্যমে কেবল যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী সায়নী ঘোষ এবং পরিবহন দপ্তরের মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী, যিনি হুগলী জেলার জাঙ্গিপাড়ার বিধায়ক- এই দুজনের সঙ্গে কুন্তল ঘোষের  ছবি দেখা গেলেও কম দেখানো হয়ছে তা হল তৃণমূলকংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব‍্যানার্জীর সঙ্গে কুন্তল ঘোষের ছবি।

জানা গেছে  ৩২৫ জন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে ১৯ কোটি ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা তুলেছেন যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষ। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ  হুগলীর বলাগড়ের বাসিন্দা এই যুব তৃণমূল নেতা।  সুতরাং কুন্তল ঘোষের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় এজেন্সি  কতটা সক্রিয় হবে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গেছে গোরু পাচার ও কয়লা পাচার কাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও অভিষেক ব‍্যানার্জীর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি ই ডি বা সিবিআই। বলাবাহুল‍্য মুখে হম্বিতম্বি করা পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা নেত্রীরাও এখন অনেকেই ব‍্যক্তিগত আলাপে তৃণমূলের ওপরতলার সঙ্গে তাঁদের দিল্লির নেতাদের বোঝাপড়া র কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ বেআইনি সম্পত্তির মালিক ,গোরু পাচার কয়লা পাচারে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অভিষেক ব‍্যানার্জীর বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর “রহস্য” অনেকেই বুঝতে পারছেন।

  বলাগড়ের শ্রীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা কুন্তল ঘোষ গত বছর ৩০শে নভেম্বর গঠিত তৃণমূল যুব কংগ্রেসের নতুন কমিটিতেই রাজ্য যুব তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কুন্তল ঘোষের নাম ঘোষণা করা হয়। শুধু হুগলী জেলা নয়, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে মুর্শিদাবাদ একাধিক বিএড, ডিএলএড কলেজে, ফার্মাসিউটিক্যাল ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কর্ণধার। কার্যত যেন শিক্ষা ব্যবসায় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন এই যুব তৃণমূল নেতা।

বলাগড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদেরই অভিযোগ গত চার পাঁচ বছর ধরে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার নাম করে এলাকা থেকে বিপুল টাকা তুলেছিলেন এই যুব তৃণমূল নেতা। শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের কাছেও সেই অভিযোগ জমা পড়েছিল। যদিও তারপরেও এই নেতার দাপট আরও বাড়ে। কয়েক মাস আগেই হুগলী জেলার পুলিশ সুপারের কাছে পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে আবেদনও করেছিলেন এই যুব তৃণমূল নেতা। তাঁর বাড়ির সামনে সিভিক ভলান্টিয়ারের ডিউটি থাকে, নিরাপত্তার জন্য। অভিষেক ব্যানার্জি থেকে সায়নী ঘোষ হয়ে রুনা খাতুনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা জানে গোটা হুগলী জেলা। ফলে পুলিশ প্রশাসনও তটস্থ থাকে।

অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার নাম করে রীতিমত টাকা তুলে তার ভাগ এবং চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা সরাসরি মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পাঠানো হতো। মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জিরও ঘনিষ্ঠ ছিল এই ব্যক্তি। প্রাইমারির লিস্ট হুগলী জেলা থেকে তাঁর মাধ্যমেই যেত। টাকার একটা অংশ মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জির কাছেও যেত। এছাড়াও শাসক তৃণমূলের আরো শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছাতো টাকার ভাগ।

বলাগড় এলাকায় একাধিক চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন এই কুন্তল ঘোষ। যদিও অনেকে চাকরি পায়নি টাকা দেওয়ার পরেও। গোটা হুগলী জেলায় এই জাল ছড়িয়েছিল। সিবিআই-এর একটি সূত্রে জানা গেছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে টাকা তুলেছিল। সিংহভাগই নগদে লেনদেন হয়েছিল। বিপুল টাকার একটা বড় অংশ শাসক তৃণমূলের নির্দিষ্ট মহলেও পৌঁছেছিল। তাই কি চাকরি দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা তোলার পরেও এমন প্রতারককে যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বানিয়ে দেওয়া হয়?

এর আগেও অভিষেক ব্যানার্জি যাঁকে যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বানিয়েছিলেন ২০১৯ সালে সেই বিনয় মিশ্র কয়লা পাচার কাণ্ডে এখনও ফেরার, ভিন দেশের নাগরিকত্ব পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিস পর্যন্ত জারি হয়েছে। কার্যত প্রতারকদেরই যেন বেছে বেছে জায়গা দেওয়া হয় যুব তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে।

গত ৭ই ডিসেম্বর নিয়োগ কাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে অতিরিক্ত চার্জশিট দায়ের করেছিল ইডি। প্রায় ১৫০ পাতার চার্জশিটে নিয়োগ কেলেঙ্কারির কিংপিন মানিক ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, তৃণমূল ঘনিষ্ঠ শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডলের নাম ছিল। ২০১৪ সালের প্রাইমারি টেটে ৩২৫ জন অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে পাশ করিয়েছিলেন মানিক ভট্টাচার্য।

 অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স সংস্থার নামও বারেবারে আসে এই নিয়োগ দুর্নীতিতে। এই সংস্থা মূলত শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে। আগে এর সভাপতি ছিলেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা নলহাটি-২ নম্বর ব্লকের সভাপতি বিভাস অধিকারী। পরবর্তীতে মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ হিসাবে তাপস মণ্ডলকে সভাপতি পদে বসানো হয়। গোটা রাজ্যে তাঁর বিএড, ডিএলএড সহ প্রায় কুড়িটি কলেজ, স্কুল রয়েছে। মহিষবাথানে ‘মিনার্ভা এডুকেশনাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা চালান তাপস মণ্ডল। ইডি, সিবিআই মিলে এখনও পর্যন্ত সাত দফায় জেরার মুখে পড়েছেন  তাপস মণ্ডল । এর আগে এই শিক্ষা ব‍্যবসায়ী  স্বীকার করেছিলেন মহিষবাথানে তাঁর অফিস থেকে মানিক ভট্টাচার্যকে ছাত্র পিছু টাকা পাঠানো হতো নিয়ম করেই।

কিন্তু সি বি আই কি বলবে,” চলো কুন্তল?” কোটি টাকার প্রশ্ন এখন সেটাই।