ব্রিটিশ শাসনে ভারতের গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও গ্রামীণ কারিগরদের ওপর শোষণ- পীড়ন অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। স্বয়ং সর্ম্পূণ গ্রামীণ অর্থনীতিও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। শাসকরা জমিদার ও রাজন্যদের ওপর আর্থিক চাপ বৃদ্ধি করে। এই চাপের বোঝা বইতে হয় কৃষকদের। কৃষকদের অবস্থা হয় বিপর্জয় কর। মহামারী ও দূভিক্ষের নির্মম হানাদারি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনে। কৃষক থেকে সরকারের কর্তৃত্ব পর্যন্ত জমির মালিকদের নানা স্তর বিন্যাস হয়। এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই সরকার তার খাজনা আদায়ের কাজ সম্পন্ন করত। প্রতিটি স্তরের মালিক তার নিম্নতর স্তর থেকে যতটা সম্ভব আদায় করে নিত।

   বৃহৎ জমির মালিকদের পক্ষে জমিতে চাষ সম্ভব ছিল না। প্রজাদের মধ্যমেই চাষের কাজ সম্পন্ন করা হত। কৃষকদের মধ্যে দারিদ্রতা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা জমিহারা হতে থাকে। জমির মালিকানা হয় আরও কেন্দ্রীভূত। জমিহারাদের একটি অংশকে দিয়ে জমিদাররা চাষ করাত ফসলের ভাগের বিনিময়ে। এই চাষিদের বলা হয় ভাগ চাষি বা বর্গাদার। উত্তর বাংলায় তাদের বলা হত আধিয়ার। আধিয়ার শব্দ থেকেই বোঝা যায়, উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক পাওয়ার বিনিময়ে কৃষক জমি চাষ করবে। অপর অর্ধেক পাবে জমির মালিক। ততৎকালিন যুক্ত বাংলায় এ ব্যবস্থা প্রসারিত হয়। পূর্ব বাংলায় জমির কেন্দ্রীভবন কম থাকায় এখানে ভাগচাষ প্রথা কম ছিল। তথ্যে দেখা যায়; বিভিন্ন জেলায় ১০ থেকে ৫৪ শতাংশ জমিতে বর্গা প্রথায় চাষ হত। মোট যুক্ত বাংলায় ২১ শতাংশ জমিতে বর্গা চাষ হত। বর্গাদারদের অবস্থা ছিল শোচনীয়।

   বাংলায় অধিকাংশ এলাকায় কৃষি জমি উর্বর। সে যুগে সেচ ব্যবস্থা না থাকায় প্রধানত একটিমাত্র চাষের ওপর নির্ভর করতে হত। তাছাড়া প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা বা পোকার উপদ্রবেও সমস্যা দেখা দিত। গরিবরা প্রায়শ মহাজনী ঋণের উপর নির্ভরশীল ছিল। ভাগ-চাষীরা জমিদারের কর্মচারীর নির্দিষ্ট করা দিনে ধান কেটে তাদেরই নির্দিষ্ট করা স্থানে ফসল গাদাজাত করত। আবার তাদের নির্দিষ্ট কয়াল (ওজন করার কর্মী) দ্বারা ধান মাপা হত। উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক অংশ ভাগ,মহাজনের ঋণের সুদ মেটাবার পর যা অবশিষ্ট থাকত, তার উপর বেআইনী আদায় চালু ছিল। ফজলুল হক সরকার যে ভূমি রাজস্য কমিশন গঠন করেন, ‘৪০ সনে তার রিপোর্ট প্রকাশ হয়। তাতে বলা হয় সুন্দর বন এলাকায় ১৩ প্রকার বেআইনী আদায় চলত- কাক তাড়ানি, খামার ছাচানি, দড়োয়ানী, পার্বণী,কয়ালী, মস্তান কর, ঈশ্বর বৃত্তি প্রভৃতি। এসব মেটাবার পরে কৃষক যা পেত তা সামান্য সময়ের খাদ্যই জুটত। তারপর অনাহার বা অখাদ্য গ্রহণই ছিলো সারা বছরের বাস্তবতা।

   ‘২০-দশকে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন শুরুর পরে এই অবর্ণনীয় দুর্দশার বাস্তবতা সামনে আসে। ১৯২৮ সনে প্রথম যশোর জেলা থেকে তেভাগার দাবী উত্থাপিত হয়। অর্থাৎ অর্ধেক নয়, উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ চাই। এক-তৃতীয়াংশ যাবে মালিকের খামারে। তাছাড়া ধান উঠবে চাষির খামারে। মালিকের নির্দেশিত স্থানে নয়। ১৯৩৬ সনে সারা ভারত কৃষক সভা গঠনের পর আন্দোলন বেশ গতি পায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় আন্দোলনে নতুন সমস্যা দেখা দেয়।

তেভাগায় সিদ্ধান্ত — যুদ্ধ শেষে, বিশেষত ৪৬ সনের গোড়ায় সামগ্রিক গণ আন্দোলন তীব্রতর হয়।বছরের প্রথম থেকেও আন্দোলন তীব্র হলেও ১৬ অগাস্ট কলকাতায় হল ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সমগ্র রাজ্যের হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে যায়। কলকাতার দাঙ্গার একমাস পরে এমন পরিবেশেই কৃষক সভা তেভাগা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে ফজলুল হকের নিযুক্ত ফ্লউড কমিশন ‘৪০ সনে তার অন্তবর্তী সুপারিশে তেভাগার প্রস্তাব করে। সে সুপারিশ ধামাচাপা থাকলেও তেভাগার সংগ্রাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

  কৃষক সভার আহ্বান ছিল- প্রতি পরিবার থেকে একজন কৃষক সভার সদস্য, একটি লাঠি এবং সাহায্য বাবদ একটি টাকা চাই। ভাগচাষীদের মধ্যে তৈরি হয় আিপুল সংগ্রামী উন্মাদনা। অবিভক্ত বাংলার ৮০ লক্ষ বর্গাদারের ৬০ লক্ষ এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রায় সমস্ত এলাকায়ই খেত মজুর এবং গরিব কৃষকের ব্যাপক অংশ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রথম পর্যায় থেকেই শহীদের তালিকায় তাই বিপুল সংখ্যক খেত মজুরের নামের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে ধান কাটার সময় মসৃণভাবেই কৃষক সভার কর্মসূচী কার্যকর হচ্ছিল। জমিদার বা তাদের কর্মচারীদের কিছু হতচকিত অবস্থায় রেখে কৃষক ধান কেটে ঘরে তুলেছে। তার বিরুদ্ধে জোতদারদের হয়ে বাধা দেওয়ার তেমন কোনো ঘটনা নজরে আসেনি। এবার জমিদাররা শঙ্কিত। সরকারের উপর তার তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। শুরু হয় গ্রামে গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন, বিশেষত তেভাগা আন্দোলনের শক্তিশালী এলাকায়।

তৎনারায়ণ বর্মণ এবং বাচ্চা মুন্সির নেতৃত্বে কৃষকরা বাধা দেয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন তৎনারায়ণ বর্মণ। ক্ষিপ্ত কৃষকদের ভয়ে জোরদাররা গ্রাম ছেড়ে পালায়। আত্মগোপনে থাকা দীনেশ লাহিড়ী, মনিকৃষ্ণ সেনের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল ও সমাবেশ হয়। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারের সাহস পায়নি। ‘৪৭ এর জানুয়ারীতে দিনাজপুরের চিরি বন্দরের একটি গ্রামে কৃষক নেতা সমীরুদ্দীনকে গ্রেপ্তার করে। সমীরুদ্দীনকে গ্রেপ্তার করে যেখানে নিয়ে যায়, সেখানে মানুষ জড়ো হয়। জমায়েতে ছিলো আদিবাসী যুবক শিবরাম। সমীরুদ্দীনকে হত্যা করতে দেখে ক্ষিপ্ত শিবরাম তার ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করে পুলিশকে হত্যা করে। পাল্টা পুলিশের গুলিতে নিহত হয় শিবরাম।

  ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে দিনাজপুরের রংপুরের ২০ শে ফেব্রুয়ারী ‘৪৭। আত্মগোপনে থাকা কৃষক নেতাদের তিন ট্রাক বোঝাই পুলিশ গ্রেপ্তার করতে গেলে বিপুল প্রতিবাদী কৃষক সমাবেশ হয়। পুলিশের গুলিতে ২২ জন প্রাণ হারায়। কলকাতা থেকে আবদুল্লা রসুল, ডাঃ বিজয় বসু এবং একজন সাংবাদিক খাঁপুরের উদ্দেশ্যে যান। বালুরঘাট থেকে গরুর গাড়ীতে যাওয়ার সময় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে এবং তিন মাসের জন্য জেলা থেকে বহিষ্কার করে। তিনদিন পরেই ২৩ শে ফেব্রুয়ারী আক্রমণ হয় কাকদ্বীপে। জোরদারদের নির্দিষ্ট দিনে ধান না ঝাড়ার জন্য কৃষকদের হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে কৃষকরা গোবিন্দরামপুরে কাছারি ঘেরাও করে। জোতদারদের গুলিতে নিহত হয় কার্তিক খাঁড়া। সংবাদ পেয়ে ছুটে আসে ক্ষিপ্ত কৃষকরা। সেদিন জ্যোতীষ রায় সহ অন্য নেতৃত্বের সুচিন্তিত, উদ্দ্যোগে রক্তস্নান এড়ানো সম্ভব হয়। দু’টি সপ্তাহ পার হতেই ৮ ই মার্চ বের মজুরের কাছারী বাড়িতে আবার গুলি। কৃষকরা তাদের গাদাজাত ধান নিতে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রবিরাম সর্দার, রতিরাম সর্দার, পাগলু সর্দার, ও চামু বিশাল। সন্ত্রস্ত জোতদাররা পালিয়ে যায়।

৪ ঠা এপ্রিল জলপাইগুড়ি জেলার মেটেলি থানায় মঙ্গলবাড়ী গ্রামে কৃষকরা তাদের গাদাজাত খামারের ধান নিতে গেলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় ৯ জন কৃষক।

   আন্দোলন ছড়িয়ে পরে মেদিনীপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, যশোর, মালদহসহ বিভিন্ন জেলায়। ‘৪৮-৪৯’এ স্বাধীন দেশেও তেভাগা আদায়ের সংগ্রাম চলে হাওড়া,হুগলী, ২৪ পরগণাসহ পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জেলায়। সর্বমোট ৮৬ জন শহীদ মৃত্যু বরণ করে। আহত শত শত, গ্রেপ্তার হাজার হাজার। ‘৫২ সনের নির্বাচন পর্যন্ত এমন অবস্থাই চলতে থাকে।

আন্দোলনের গুরুত্ব– কুৎসিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তেভাগা আন্দোলন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। আন্দোলনের কোনোও এলাকায় কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। তার মধ্যে উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত কুমিল্লা জেলার হাসনাবাদ। পাশাপাশি ১০/১২ টি গ্রামে আন্দোলন ছিলো বেশ শক্তিশালী। নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় ৩ হাজার হিন্দু পরিবারকে গ্রামগুলি আশ্রয় দেওয়া হয়। দিন-রাত স্বেচ্ছাসেবক প্রহরায় তাদের জীবনযাত্রা ছিলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

  আন্দোলনের প্রভাবে ‘৪৯ এর বর্গা অর্ডিন্যান্স, ‘ ৫৩ এবং ৫৫’ জমি দাবী অধিগ্রহণ, ‘৬৭- ‘৬৯-‘৮২ ভূমি সংস্কার এবং পরবর্তী কৃষক আন্দোলন এ লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা।

   এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি সংগ্রামের ময়দানে কৃষক রমনীদের উজ্জ্বল ভূমিকা। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালনের পরে, তারা লড়াইয়ের ময়দানে ছিলেন বীরঙ্গনার ভূমিকায়। গ্রামীণ সমাজে নারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এ লড়াই গুরুত্ব বহন করে।

   সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তেভাগা আন্দোলনের কালজয়ী ভূমিকা অনস্বীকার্য। আন্দোলনে অত্যন্ত শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় নাটক,গান,চিত্র শিল্পে। ছোট বকুলপুরে যাত্রী, হারানের নাত জামাই অসাধারণ সাহিত্য। তেমনি সোমনাথ হোড়ের ছবি তাকে অমর করেছে। অমর করেছে তেভাগার সংগ্রামকে।

   মনে রাখা দরকার দেশ তখন স্বাধীন হওয়ার পথে। সুতরাং স্বাধীন দেশের কল্পনা, পরবর্তী বাস্তবতা মানুষের মন দখল করেছে। ফলে এ আন্দোলনের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগের বাধা ছিলো। বিশেষ করে ‘৪৮-৪৯ পর্যায়ে স্বাধীন দেশের চিন্তাই প্রাধান্য পায়। তাছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের বিষয়টি উঁকি দেওয়ার ফলে বিষয়টি জটিল হয়। ৪৬ এর গোড়ায় দেশব্যাপী গণ বিস্ফোরণ সঠিক পরিণতি পেলে তেভাগার লড়াই হয়তো সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করতে পারত বলে অনেকের অভিমত।

দূর্বলতা– বাংলার এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সৃষ্টিকারী আন্দোলনের কিছু দূর্বলতাও অস্বীকার করা যায় না। এতো বড়ো লড়াই সংঘটিত করতে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল, সে ক্ষেত্রে কিছু অভাব অস্বীকার করা যায় না। আন্দোলন সংঘটিত করার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যে কৌশল এবং নমনীয়তার প্রয়োজন ছিলো, সব ক্ষেত্রে তা গুরুত্ব পায়নি। এই দূর্বলতা না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি সীমিত হতে পারত। মেদিনীপুর এবং কাকদ্বীপে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিলো। গণ আন্দোলনের সাফল্যের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই অন্য অংশের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তেভাগার সংগ্রামের খেত মজুর এবং গরিব কৃষকের সহায়তা ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বুদ্ধি জীবীসহ অন্য অংশের সহায়তার অভাব ছিলো। উত্তর বাংলার রেল শ্রমিক এবং বিশেষ করে চা শ্রমিকের শক্তিশালী সহায়তা এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রমী ঘটনা।

  তবুও এ কথা সত্য ; বাংলার গণ আন্দোলনের ইতিহাসে তেভাগার লড়াই বিশেষ স্থান নিয়েছে এবং পরবর্তী কৃষক সংগ্রামে শক্তিশালী প্রেরণায় সমৃদ্ধ করেছে। ৭৫ বছর পার হওয়ার পরও তাই তেভাগার সংগ্রাম গুরুত্ব পেয়ে থাকে।