প্রত্যেক আন্দোলনের একটা পশ্চাৎপট থাকে, থাকে আর্থসামাজিক কারণ—যে কারণগুলো সেই আন্দোলনকে অনিবার্য করে তোলে। তেভাগা আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল সেই রকম একটি পশ্চাৎপটের ওপরেই। সেই পশ্চাৎপটের একটি হল যুগ যুগ ব্যাপী কৃষকের ওপর বঞ্চনা, জুলুম , অত্যাচারের ইতিহাস, যা সুদূর ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকে বংশানুক্রমে কৃষক প্রত্যক্ষ করেছে-সহ্য করেছে। আর একটি হল গত শতাব্দীর তিনের দশক অর্থাৎ ১৯৩০ সাল পরবর্তী বিভিন্ন কৃষক বিরোধী ব্যবস্থা ও জুলুম এবং তার বিরুদ্ধে বর্গাদার- আধিয়ারদের লড়াই। ফসলের অর্ধেকের দাবিতে লড়াই থেকে বর্গাদারদের নাম হল আধিয়ার। যদিও জোতদারদের পক্ষে নির্বিচার পুলিশি হামলা, গ্রেপ্তার, দমন পীড়নে সাময়িকভাবে এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জাপানি বোমা বর্ষণ তথা জাপানের বার্মা দখল এবং যুদ্ধে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর জন্য সরকার অতিরিক্ত চাল সংগ্রহের ব্যবস্থা করায় বড়ো জমির মালিকরা বাড়তি দাম পেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠল। খাদ্য ঘাটতি প্রদেশ হিসাবে বাংলার চাল আমদানি হত বার্মা থেকে। বার্মা জাপানের দখলে চলে যাওয়ায় এই চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। চাল দুর্মূল্য হয়ে পড়ে। গ্রামের গরিব মানুষ সহ বর্গাদার আধিয়ারদের সংকট বেড়ে যায় বিপুলভাবে।   

বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে জাপানি আক্রমণের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার ‘ডিনায়েল পলিসি’ বা অননুমোদন নীতি  গ্রহণ করে। অর্থাৎ নৌকা, সাইকেল ইত্যাদি পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে আক্রমণকারী জাপান এই পরিবহনের দৌলতে বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় ঢুকতে না পারে। ফলে সুন্দরবন অঞ্চল সহ নোয়াখালী, বরিশাল, মেদিনীপুর প্রভৃতি উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে বিভিন্ন পেশার গরিব মানুষ ও মাঝিমাল্লাদের জীবনে ভয়ানক সংকট নেমে আসে। নিজেদের বৃত্তি ও পেশার কাজ না থাকায় সমুদ্র ও নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের চাপ গিয়ে পড়ে কৃষিক্ষেত্রের ওপর—যা কৃষিক্ষেত্রের সংকট আরও বাড়িয়ে তোলে।এর পাশাপাশি ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসে এক ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে বিশেষ করে মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। আক্রান্ত এলাকায় ধানের চারা সমুদ্রের লোনা জলে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কারণগুলির মধ্যে এই ঘুর্ণিঝড় ও প্লাবনে আমন ধান উৎপাদনের ব্যাপক ঘাটতি  অন্যতম।  ১৯৪৩ সাল মানে বাংলার ১৩৫০ সাল। ওই বছরের এপ্রিল মাস থেকে পরের বছর এপ্রিল পর্যন্ত চলেছিল এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দাপট। এই দুর্ভিক্ষে ৩৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হল। যাদের বেশির ভাগই ভাগচাষী ও ক্ষেতমজুর। কৃষকের অভাবের সুযোগ নিয়ে জোতদার ও মজুতদাররা কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে আরও বেশি জমির মালিক ও আরও বেশি ধনীতে পরিণত হয়। বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত  বিরাট অঞ্চল হয়ে ওঠে তেভাগা আন্দোলনের ঝটিকা কেন্দ্র।১৯৪৫ সালের অক্টোবর থেকে বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত, যুদ্ধবিধ্বস্ত, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের ব্রিটিশ বিরোধী রোষের প্রকাশ ঘটতে লাগল বিক্ষোভ-সমাবেশ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে।এল ১৯৪৬ সাল। ভারত যেন ব্রিটিশ বিরোধী ঘৃণা ও দেশপ্রেমের শপথে পুঞ্জিভূত বারুদের স্তূপ।আজাদ হিন্দ বাহিনীর দেশপ্রেমিক যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন, আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে সংঘটিত রশিদ আলি দিবস, নৌ বিদ্রোহ, হরতাল-ধর্মঘটে উত্তাল সারা দেশ।১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের উজ্জ্বল নিদর্শন দেখে শঙ্কিত ব্রিটিশ শক্তি সাম্প্রদায়িক কৌশল অবলম্বন করে ভারতকে দ্বিখন্ডিত করে স্বাধীনতা প্রদানের চক্রান্তে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আদায়ের দাবিতে মদত দান করল। এর পরিণামে বাংলাজুড়ে ১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাস থেকে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার বিষবাষ্পে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল। কলকাতা শহর সহ নোয়াখালীর কদর্য দাঙ্গা পরিস্থিতির মধ্যেই ২৯-৩০ সেপ্টেম্বরের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক কাউন্সিলের সভা থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, খাদ্যের দাবিতে ও আসন্ন ফসল কাটার মরশুমে তেভাগার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। আওয়াজ তোলা হল—‘এই মরশুমেই তেভাগা চাই’। মাত্র দুই মাসের প্রস্তুতিতে শুরু হয়ে গেল  ঐতিহাসিক তেভাগার সংগ্রাম। এই প্রশ্নে কৃষকরা সুবিধা পায় তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক নিয়োজিত ‘ফ্লাউড কমিশন’-এর সুপারিশে—‘ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে কৃষক তথা বর্গাদার বা ভাগচাষী’।   

পাঁচ বছর ধরে চলে তেভাগা আন্দোলন। কৃষকদের অভূতপূর্ব সংগ্রামে জেগে ওঠে মৈমনসিংহ জেলার হাজং থেকে দক্ষিণ বাংলার কাকদ্বীপ। কমবেশি উনিশটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল এই আন্দোলন। আন্দোলন দমনে চলে ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন, চলে গুলিবর্ষণ। নির্বিচারে সংঘটিত হয় লুঠ, গৃহদাহ, নারী ধর্ষণ ও গ্রেপ্তারি।গুলি চলে জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর, মৈমনসিংহ সহ অনেক জেলায়। এক দিনাজপুরের খাঁপুরেই একশ রাউন্ড গুলি চালিয়ে কুড়ি জনকে হত্যা করা হয়। খাঁপুরের ঘটনা সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়। সংঘর্ষ শুরু হয় কৃষকের সঙ্গে জোতদার ও পুলিশের।     কাকদ্বীপ তথা দক্ষিণ বাংলায় কৃষক সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে। পাঁচ বছর ধরে চলেছিল এই সংগ্রাম। কাকদ্বীপের লয়ালগড় বা লালগড় হয়ে উঠেছিল সংগ্রামের প্রধান রণক্ষেত্র। ক্রমে ক্রমে চন্দনপিঁড়ি, বুধাখালী সংগ্রামের এক একটি ঝটিকা কেন্দ্রে পরিণত হয়। চন্দনপিঁড়ির চাষি মা অহল্যা সহ সরোজিনী, উত্তমী, বাতাসী এবং চাষিবীর অশ্বিনী দাস, গণেশ ভুঁইয়া, নীলকন্ঠ,সুধীর, সুরেন, নগেন দলুই, মণি ধাড়া প্রমুখের নির্ভীক আত্মদানে অমর হয়ে আছে কাকদ্বীপের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস। অমর হয়ে আছে বুধাখালী, চন্দনপিঁড়ি। পরবর্তীকালে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করেছে সন্দেশখালী, ভাঙ্গড়, সোনারপুরের কৃষক সংগ্রাম।       

১৯৪৬-এর বাংলা ছিল সাম্প্রদায়িকতার হলাহলে জর্জরিত। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের প্রভাব যে সব জেলাতে পড়েছিল, সেখানে কোনও দাঙ্গা হয় নি। এক অনন্যসাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন হল তেভাগা আন্দোলন। কৃষকের দাবিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রেণি ঐক্য গড়ে উঠেছিল এই আন্দোলনে। আন্দোলনের কুশীলব ছিল মুসলমান, নমঃশূদ্র, হাজং, সাঁওতাল সহ বিভিন্ন জাতি-উপজাতির কৃষকরা। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ক্ষেতমজুররাও। আকাল ও দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে অনেক বর্গাদার জমিজমা, হাল-বলদ, ঘটিবাটি খুইয়ে ক্ষেতমজুরের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিল তেভাগা সংগ্রামের সঙ্গে তাদের ভাগ্য জড়িত।এর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল কৃষক রমণীরা। পুরুষদের পিছনে ফেলে  তারা সামনের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আগুনের তেজে জ্বলে উঠেছিল ঠাকুরগাঁর রাজবংশী ভান্ডণী, দীপেশ্বরী, খাঁপুরের শহীদ যশোদা বর্মণী, হাজং বীরাঙ্গনা রাসমণি, শঙ্খমণি, রেবতী, কাকদ্বীপের অহল্যা, বাতাসী, সরোজিনী, উত্তমী, নড়াইলের দুর্ধর্ষ নেত্রী সরলা ও তার তিনশ মেয়ের স্বনামখ্যাত ঝাঁটা বাহিনী।সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তেভাগার শ্রেণি সংগ্রাম ছিল জোঁকের মুখে নুনের ছিটে। সম্প্রসারিত শ্রেণি সংগ্রামের মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। এমনকি অসংগঠিত এলাকাতেও। জাতিগত ভেদাভেদের মূলেও প্রচন্ড আঘাত দিয়েছিল এই আন্দোলন। ভেঙ্গে গিয়েছিল মুসলিম, নমঃশূদ্র, রাজবংশী, পৌন্ডক্ষত্রিয়, মাহিষ্য প্রভৃতি সামাজিক ব্যবধান। সর্বার্থে এই আন্দোলনের শিক্ষা ভবিষ্যৎ যেকোনো আন্দোলনের পথ নির্দেশক হতে পারে।     

 তেভাগা ছিল ফসলের দাবির আন্দোলন। এই আন্দোলনের সাফল্য পরবর্তী সময়ে স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৭-৬৯ সালের জমির আন্দোলন অর্থাৎ হাজার হাজার বিঘা বেনাম জমি দখলের আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রেরণা সৃষ্টি করে। সেই আন্দোলনের আহ্বান ছিল-‘বেনাম জমি দখল করো, দখল রেখে চাষ করো’। সেও এক ইতিহাস। তেভাগা আন্দোলনের উজ্জ্বল ইতিহাসের ধারায়  সৃষ্ট আর এক ইতিহাস।তেভাগা আন্দোলনের ৭৫ বছরে রচিত এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধের শেষে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সংগ্রামী কৃষক ও শহীদদের প্রতি রইল নিবন্ধকারের গভীর শ্রদ্ধা।