আজ ১লা সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবস। ১৯৩৯ সালের এই দিনেই অর্থাৎ ১লা সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ধ্বংসলীলা ও ক্ষয়ক্ষতির বিচারে যে যুদ্ধ সারা পৃথিবী জুড়ে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। যা পূরণ করতে লেগে গেছে অনেকগুলি বছর। এই পৃথিবীতে সংঘটিত দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা গণনায় রেখে ১লা সেপ্টেম্বর দিনটিকে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। এই দিনটি যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে শপথ নেবার দিন।
মনে রাখতে হবে যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে সাম্রাজ্যবাদও থাকবে। থাকবে যুদ্ধের বিপদও। পৃথিবীতে সংঘটিত দুটি বিশ্বযুদ্ধ অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধ। বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদ আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির চেহারায় আরো আগ্রাসী। আরো বেশি মুনাফা ও শোষণের লক্ষ্যে নিত্যনতুন কায়দায় পুঁজিবাদ নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে চলেছে। অতি দক্ষিণপন্থী রূপ ধরে পুঁজিবাদ কেড়ে নিতে চায় শ্রমিকশ্রেণির ও আপামর সাধারণ মানুষের ন্যূনতম অধিকার। নিজেদের সংকট আড়াল করতেই তাদের এহেন আগ্রাসী রূপ। সাম্রাজ্যবাদ তার রূপ বদলেছে। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের নেতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হরনে ক্রিয়াশীল নানা কায়দায়। কোথাও অর্থনৈতিক আগ্রাসন কোথাও বা সামরিক আগ্রাসন। একই সাথে চলছে জাত-পাত-সম্প্রদায়গত বিভাজনের অস্ত্রে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ভেঙ্গে দেবার চক্রান্ত।
বিশ্বব্যাপী লগ্নি পুঁজির স্বার্থে তৈরি নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদ ২০০৮-এর আর্থিক মন্দার সময় থেকেই এক ব্যবস্থাগত সংকটের মধ্যে রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও বিশ্ব অর্থনীতি এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। ফলস্বরূপ বিপুল কর্মহীনতা, অভিবাসীদের নিয়ে আতংক, উগ্র জাতি বিদ্বেষ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্ত পরিসরে সাম্রাজ্যবাদী নয়া উদারবাদী আগ্রাসন অতীতের সব নজির ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো সহযোগিরা দেখিয়ে দিয়েছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা মুক্ত বিশ্ব তারা চায় না। সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কতটা নগ্ন হতে পারে তার নিত্যনতুন নজির তারা সৃষ্টি করে চলেছে ন্যাটোর পূর্ব দিকে অগ্রগমনের কারণে সংঘটিত রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে, প্যালেস্টাইনে মার্কিন মদতে ইস্রায়েলি আগ্রাসনে, আফগানিস্তানে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা ও চীনকে বিপদে ফেলার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। বড়ো আকারে যুদ্ধ হচ্ছেনা মানেই এই নয় যে, স্থায়ী শান্তি বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির বিশ্ব কোম্পানিগুলির লাভের বহরে সেকথা প্রমাণ হয়।
যুদ্ধের হার্ডওয়্যার বিক্রিতে সবথেকে বেশি লাভ করা ২০টি কোম্পানির খতিয়ান (বিলিয়ন ডলারে):—
Lockheed Martin 40.8
Boeing 29.5
Raytheon 22.9
Bae System 22.8
Northrop Grumman 21.4
General Dynamics 19.2
Airbus Group 12.5
L3 Communications 8.9
Leonardo 8.5
Thales 8.2
United Technologies 6.9
Huntington Ingalls 6.7
UAC 5.2
Bechtel 4.9
Textron 4.8
Rolls Royce 4.5
Leidos 4.3
Harris 4.2
OCK 4.0
Booz Allen Hamilton 4.0
আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিপদ ঘনীভূত হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব ভূ-স্ট্রাটেজিক অধিকারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার লক্ষ্যে আমাদের বিদেশনীতিকে ধাপে ধাপে পরিবর্তন করার প্রচেষ্টায়। ফলত, বিভিন্ন প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের স্বীকৃতি ও মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন আমরা দেখতে পাচ্ছি আমেরিকার ‘চীনকে ঘেরো নীতি’কে কার্যকরি করতে ভারতকেও সামিল করছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। তাই দক্ষিণ-চীন উপসাগরে তথাকথিত মুক্ত জাহাজ চলাচলে, মার্কিন-জাপান যৌথ টাস্কফোর্সে ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণে এবং আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া যৌথ সামরিক উদ্যোগে যে পথে চীনের পেট্রোপণ্যের বড়ো অংশ যাতায়াত করে সেই মালাক্কা প্রণালীতে চীনের জাহাজ আটকে দেবার চেষ্টায় ভারত সামিল। এছাড়া চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর তৈরিতে আপত্তি জ্ঞাপনে ও তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেবার মার্কিন নীতির সঙ্গে সহমত পোষণে ভারত সরকার সামিল।
আমাদের দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় যুক্ত হওয়া সহ নানা প্রক্রিয়ায় ওদের জুনিয়র পার্টনার হওয়ায় সচেষ্ট। মার্কিন চাপে রাষ্ট্রসংঘের নীতি লঙ্ঘনকারী ইস্রায়েলের সঙ্গেও অশুভ আঁতাত গড়ে তুলেছে আমাদের সরকার। পরিণামে প্যালেস্টাইন, ইরানের মতো দেশগুলির সঙ্গে দীর্ঘ মিত্রতার সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হচ্ছে চীন সহ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গেও।
এ সবই ঘটছে মার্কিন রণনীতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করার লক্ষ্যে। এর সাথে গড়ে তোলা হয়েছে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া ও জাপানের জোট ‘কোয়াড’ ( Quad)।
আন্তঃ সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব আজকের দিনেও ক্রিয়াশীল। তবে তা অনেকটাই স্তিমিত। ১)প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি ভঙ্গ করা ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মতো ইউরোপীয় শরিকরা ভালোভাবে নেয়নি। ২) ব্রেক্সিট গণভোটের পর ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, রাশিয়া ও চীন প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো প্রধান ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। ৩)রাশিয়াকে জি-৭ গোষ্ঠী থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। রাশিয়া সিরিয়ার আসাদ সরকারকে সমর্থন করে এবং সিরিয়ার সরকারকে অস্থিতিশীল করার প্রক্রিয়া এর ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে। ৪) ইরানের সঙ্গেও তারা নিজেদের সম্পর্ক মজবুত করে তোলে।
রাশিয়া এখন একটি বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তি— যারা নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও প্রভাবের জায়গা বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
এই দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের মধ্যে না পড়লেও, আন্তঃপুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়বে।
মার্কিন-চীন সংঘাত : চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর চীনই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। প্রযুক্তি ভিত্তিক শক্তিতেও বিপুলভাবে অগ্রসর হচ্ছে চীন। চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)-এ ৬০টির বেশি দেশ অংশগ্রহণ করছে—যা তাদের ভূরাজনৈতিক ব্যাপ্তির এক শক্তিশালী নিদর্শন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ান দেশগুলি, জাপান চীনের অর্থনৈতিক সহযোগী ও বাণিজ্যিক অংশীদার। এরা কেউ চীন বিরোধী প্রচারে লিপ্ত হতে চায়না। শুধুমাত্র ভারত ও অষ্ট্রেলিয়াই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর সংযুক্ত মার্কিনী কৌশলে সম্পূর্ণভাবে যোগ দিয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান মার্কিন-চীন সংঘাত হল সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব।
এই সময়ের একটি সাম্রাজ্যবাদী হীন ষড়যন্ত্রের নমুনা হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি খারিজের চেষ্টা। গত ৫ দশকে স্বাক্ষরিত প্রতিটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি তারা খারিজ করতে চাইছে। যথা: ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি, স্ট্রাটেজিক আর্মস রিডাকশন ট্রিটি (START)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রাসী নীতি ইরান, ভেনেজুয়েলা, কিউবার বিরুদ্ধে এবং চীনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কৌশলের কেন্দ্রিকরণ। যা আগামী দিনের জন্য বাড়িয়ে তুলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ ও আগ্রাসনের আশংকা।
এই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে শান্তি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাকে। প্রথম কথা বর্তমান সময়ে শান্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। এখন শান্তি আন্দোলনকে সংগ্রাম চালাতে হয় যুদ্ধের কারণগুলির মোকাবিলাতেও। সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বিদ্বেষ ও সংঘর্ষ, মৌলবাদী হিংসা, সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক স্বৈরাচার, সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য এসবের বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলন বিশ্বজুড়ে সরব। শান্তি আন্দোলন মানবাধিকার, তথ্যের অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকারের স্বার্থে সক্রিয়। শান্তি আন্দোলনকে পরিবেশ রক্ষার পক্ষেও লড়তে হয়। দাঁড়াতে হয় আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি শাসিত সাম্রাজ্যবাদী নয়া উদারবাদ ও বিশ্বায়ন বিরোধী সংগ্রামের পাশে।
আর একটি প্রসঙ্গ অবতারণা না করা ঠিক হবেনা। কোভিড অতিমারির আবহে সাম্রাজ্যবাদ আগের চাইতে আরো বেশি আগ্রাসী চেহারায় জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ। পরিণামে দুর্গত মানুষের খাদ্য, স্বাস্থ্য সহ জরুরি দাবি আরো বেশি উপেক্ষিত। কি আমাদের দেশে, কি অন্য দেশে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি।
এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের চিনে নিতে হবে পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ। আসুন আওয়াজ তুলি—সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। বিভেদ নয় ঐক্য চাই।