কৃষক আন্দোলনে কৃষকবিরোধী তিন কৃষি আইন বাতিলের সাথে বিদ্যুৎ বিল বাতিলের  দাবিও ছিল অন্যতম। সেই ‘দ্যা ইলেকট্রিসিটি (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০২২ সংসদের গত বাদল অধিবেশনে লোকসভায় পেশ করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় শক্তি মন্ত্রী আর কে সিং এই বিলটি করে, শক্তি বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে বিবেচনার জন্য পাঠানোর অনুরোধ করেন।  ২০০৩ সালের ইলেক্ট্রিসিটি অ্যাক্টের পরিবর্তন, পরিমার্জন করে তৈরি করা এই বিলটি এখন সংসদের এই স্ট্যান্ডিং কমিটির বিবেচনাধীন।


সংসদে এই বিল পেশের আগে থেকেই সারা দেশের কৃষক সম্প্রদায় এই বিল বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।  ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কর্মরত প্রায় ২৭ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার এই বিলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। বামপন্থীরাও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন।


 এই বিলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকঃ


১। এতদিন বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি বিদ্যুৎ বন্টনের পরিকাঠামো তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ সহ খুচরো বিদ্যুৎ বিক্রি করত। নতুন বিলে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য দুটি সংস্থার উল্লেখ রয়েছে– ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং সাব- ডিস্ট্রিবিউশন লাইসেন্সি। অর্থাৎ  একাধিক বেসরকারি সংস্থাকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার ছাড়পত্র দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ টেলিকম সংস্থার মতো একাধিক সংস্থা এবার থেকে বিদ্যুতের সংযোগ দেবে। তার মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নিতে পারবেন গ্রাহকরা।


২। রাজ্যের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদস্য এবং চেয়ারম্যান নির্বাচন এবং নিয়োগের অধিকার আছে রাজ্য সরকারের হাতে। নতুন বিলে কেন্দ্রীয় সিলেকশন কমিটির হাতে এই নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার  প্রস্তাব রয়েছে।


৩। এতদিন বিদ্যুৎ নীতি অনুযায়ী বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি রাজ্যে বিদ্যুৎ পরিষেবা নিয়ন্ত্রন করতেন। নতুন বিলে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি নীতি যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে কিন্তু এই নীতি তৈরির ক্ষমতা ন্যাস্ত করার প্রস্তাব রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।


৪। বিদ্যুৎ মাশুল নির্ধারণে সরকারি ভর্তুকি ধরা হবে না। সরকার ভর্তুকি দিতে চাইলে সরাসরি বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে এই বিলে।


৫। বিদ্যুৎ মাশুল নির্ধারণে অনেক কিছু বিবেচনায় আনা হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। মুখ্য উদ্দেশ্য ক্রশ সাবসিডিকে দ্রুত বিলুপ্ত করা।


৬। জল বিদ্যুৎ, সৌর বিদ্যুৎ, বাযু বিদ্যুতের মত পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির বিকাশের জন্য এই বিদ্যুতের ব্যবহার বাধ্যতামূলক ছিলই। এতদিন নির্ধারিত লক্ষমাত্রায় এই বিদ্যুৎ ব্যবহার না হলে পেনাল্টির কোনও উপায় ছিল না। নতুন বিলের উদ্দেশ্য বাধ্যতামূলকের সাথে পেনাল্টি জুড়ে দেওয়া হয়েছে।


৭। বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি যদি বিদ্যুৎ কেনার ব্যাপারে পেমেন্ট সিকিউরিটি না দেয় তাহলে রাজ্য বা আঞ্চলিক লোড ডেসপ্যাচ সংস্থা সেই বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির সিড্যুলিং বা ডেসপ্যাচ করতে পারবে না। এই বিষয়টি নতুন।


কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হল বিদ্যুত বণ্টন এবং খুচরো বিক্রির ক্ষেত্র বেসরকারি করণের জন্য রাস্তা তৈরি করা। বিদ্যুৎ বিলের যে বিষয়গুলি আশঙ্কার সেগুলি হলঃ 
(ক) ক্রস সাবসিডি তুলে দেওয়া ফলে  গ্রামীণ বিদ্যুৎ পরিষেবার দাম বাড়বে। এতে কৃষিক্ষেত্রে খরচ বাড়বে। 


(খ) এখন বিদ্যুৎ সংবিধানের যৌথ তালিকায় রয়েছে। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিলে রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করে  সরাসরি কেন্দ্রের  নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে। 
(গ) বিদ্যুৎ পরিষেবার বেসরকারিকরণ। নিলাম ডেকে  সরকারি বিদ্যুৎ পরিষেবার লাভজনক এলাকা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হবে।

বিল অনুযায়ী, সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাগুলি সর্বজনীনভাবে বিদ্যুৎ পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকলেও বেসরকারি ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাছে স্বাভাবিক পছন্দের জায়গা হবে শহর কারণ এখানে বড় বিদ্যুৎ গ্রাহকদের তুলনায় লাইফলাইন অর্থাৎ গরীব গ্রাহকের সংখ্যা কম। গ্রামে বিদ্যুৎ বিক্রিতে বেসরকারি ফ্র্যাঞ্চাইজিদের আগ্রহ যে থাকবে না তা বলার অপেক্ষাই রাখেনা। ফলে গ্রামে বিদ্যুৎ বিক্রির দায়িত্ব রয়ে যাবে সরকারি বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির হাতে। গ্রামে যেহেতু ধনী গরীবে ফারাক খুব কম ফলতঃ ক্রস সাবসিডির ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হবে।


বিদ্যুৎ পরিষেবায় শিল্প, বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বেশি এবং লাইফ-লাইন এবং গ্রামের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের, কৃষি ক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত জায়গায় বিদ্যুতের দাম কম। বিভিন্ন ক্যাটেগরির গ্রাহকদের মধ্যে বিদ্যুতের দামের এই ফারাক হল ক্রস সাবসিডি। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল, ২০২২ শে পরোক্ষ ভাবে এই ক্রস সাবসিডি প্রভাবিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি এবং গ্রামের বিদ্যুৎ গ্রাহকরা।


ভালো বিদ্যুৎ গ্রাকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি সবসময়ই লোভনীয়। সাত আট বছর আগে, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি হয়েও দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে বড় শিল্পের বিদ্যুৎ বিক্রি শুরু করে এই সব গ্রাহকরা আগে রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির থেকে বিদ্যুৎ কিনত। ফলে রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্রস সাবসিডি প্রভাবিত হয়। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে এই ভালো গ্রাহকদের ফুঁসলে নিয়ে যাওয়াকে ‘চেরি পিকার’ বলা হয়।


এক কথায় বলা যায় সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য্য বিদ্যুতের দাম বাড়বেই এবং কৃষকরা যে দরে বিদ্যুৎ কৃষি কাজে ব্যাবহার করতেন তার দাম বাড়বেই। জনস্বার্থে বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল, ২০২২ বাতিল করতে হবে।