ইরানে গত মাস তিনেক ধরে সেখানকার মৌলবাদী সরকারের বিরুদ্ধে এক বিপুল গণবিক্ষোভ চলছিল। তার সূত্রপাত ঘটে মাহসা আমিনি নামে কুর্দ জাতিগোষ্ঠীর একটি ২২ বছরের মেয়ের অপমৃত্যুতে। হিজাব না পরে বাইরে বেরোনোর অপরাধে সে ইরান সরকারের ‘নীতিরক্ষক পুলিশে’র হাতে গ্রেফতার হয়েছিল; পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীনই তার মৃত্যু ঘটে। অভিযোগ ছিল মৃত্যুর কারণ হেফাজতে নির্যাতন। এর প্রতিবাদে মেয়েরা প্রকাশ্যে হিজাবের বহ্ন্যুৎসব করে এবং লম্বা চুল কেটে ফেলে অপমানজনক এই নজরদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ইরানের অনেক পুরুষও তাদের সপক্ষে রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিবাদে সামিল হন।

পুলিশ ও সেনাবাহিনী নামিয়ে এই বিক্ষোভকে দমন করা যায়নি, বেশকিছু মানুষের হতাহত হবার ঘটনাও ঘটে গেছে। তারপর সরকার কিছুটা পিছু হটে ‘নীতি-পুলিশ’ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। খোদ ইরানের এটর্নি-জেনারেল জানিয়েছেন, এই নৈতিক নজরদারি ইরানের আইনি ব্যবস্থার অংশভুক্ত নয়। কট্টরপন্থী রাইসি-জমানা বিক্ষোভকারীদের সবাইকে এখনো ছাড়েনি, কিন্তু হয়তো তারা এটুকু বুঝেছে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শকুনের নজর যে সরকারের ওপর রয়েছে দেশের মধ্যে আমজনতার এমন বিক্ষোভ বাড়তে না দেওয়াটা তাদের নিজেদেরই স্বার্থের অনুকূল। ইরানের ঘটনাটিকে আমাদের দেশে আবার হিন্দুত্ববাদীরা কাজ লাগাতে চাইছে গোটা মুসলিমসমাজের বিরুদ্ধে।

মুসলিমমাত্রেই ধর্মান্ধ এবং নারীমুক্তির বিরোধী, হিজাবের বিষয়টিকে এইভাবেই তারা তুলে ধরতে চাইছে। কর্ণাটক সরকার সম্প্রতি মুসলিম ছাত্রীদের ‘হিজাব’- নামক একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে মাথা ঢেকে কলেজে ঢোকার ওপর কার্যত যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আর এস এস-এর প্রচারে তা আধুনিকতার সপক্ষে এবং মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে এক আপসহীন পদক্ষেপ। কলেজে হিজাবের ব্যবহার অনুমোদন করা তাদের মতে ‘মুসলিম-তোষণে’র একটি উদাহরণ এবং বিদ্যায়তনে সবার অভিন্ন পোষাকের নিয়মের ব্যত্যয়। লক্ষণীয় যে আরো সম্প্রতি তারা হঠাৎ করে সমান দেওয়ানি বিধি চালু করার যে কথা বলছে সেখানেও নিজেদের প্রগতিশীলতার পরাকাষ্ঠাহিসাবে তারা তুলে ধরতে চাইছে; লিঙ্গসাম্যের যুক্তি দিয়েই পারিবারিক আইনের পুনর্বিবেচনার জিগির তুলছে।

2

একটি বিষয়কে তার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর হাতিয়ারহিসাবে ব্যবহার করা আর এস এস- বিজেপির অনেক পুরোনো রণকৌশল। এই প্রচারের জবাব দেওয়া তাই আমাদের পক্ষে জরুরি। কিন্তু মুশকিল হল আমাদের দেশের অনেক প্রগতিশীল মানুষও বলছেন যে ধর্মনিরপেক্ষতাই যদি আমাদের অবশিষ্ট হয় তাহলে ছাত্রীদের হিজাব পরে কলেজে আসাকে কীভাবে সমর্থন করা যায়? বস্তুত মন্দির থেকে টিকাতিলক ধারণ করে হিন্দুর বা মাথায় পাগড়ি পরে শিখ ছাত্রের কলেজে আসার বিষয়েও হয়তো এঁরা অস্বস্তিবোধ করবেন, কিন্তু প্রশ্ন কলেজ প্রাঙ্গণে এগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনো ছাত্রের শিক্ষার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারবেন কী? স্কার্টব্লাউজ/ শাড়ি/ সালোয়ার-কামিজের সুবিধামতো বৈকল্পিক ব্যবহার ইউনিফর্মের নামে বন্ধ করতে পারবেন কী?

মেয়েদের ‘শালীনতা’ রক্ষার নানা বিধান মুসলিমসমাজেই শুধু আছে তাই নয়, উত্তরভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও ঘুংঘটের প্রচলন এখনও অনেক জায়গায় রয়েছে। এমন সব বিধান এদেশে বিশেষভাবে ইসলামিক সংস্কৃতির অবদান নয়। এদেশে অনেক প্রাচীন কালেও বড়ো ঘরের অন্তঃপুরিকারা অসূর্যম্পশ্যা ছিলেন তার প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। আবার হিন্দু বিবাহিত মেয়েদের ভব্যতার চিহ্ন হিসাবেই পরিগণিত হয় শাঁখা-সিঁদুর। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়েদের আচরণীয় এইসব বিশেষ প্রথা যে ঐ সমাজে তাদের তুলনায় হীন অবস্থার চিহ্ন তাতে সন্দেহ নেই। আবার এর একটি উলটো শ্রেণিগত দিকও রয়েছে; আধুনিক কালের একটি উদাহরণ, উনিশ শতকের গোড়ায় ত্রিবাংকুরের মহারাজার সেই কুখ্যাত হুকুমনামা যার বলে ঐ রাজ্যের দলিত নারীরা দেহের উর্ধ্বাংশ ঢাকার অনুমতি পেতেন বিশেষ একটি কর প্রদানের বিনিময়ে। অর্থাৎ, কোনও মেয়ের ভব্যতার অধিকার আছে আর কার নেই প্রথাবদ্ধ সমাজে তাও ঠিক করার ভার সমাজের কর্তাব্যক্তিদের ওপরেই।

3

সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে নানা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসবের কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিছু কিছু রয়ে গেছে। আবার সাম্প্রতিককালে ফ্রান্সে অভিবাসী মুসলিম মহিলারা হিজাবের বিরুদ্ধে সরকারি ফতোয়া মানতে অস্বীকার করেছেন সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক অধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগে। এতে একথাই প্রমাণিত যে ওপর থেকে ফতোয়া দিয়ে সমাজসংস্কার করা যায় না, বরং সংখ্যালঘুর মনে তা সন্দেহের জন্ম দেয়, সেই সমাজের কট্টরপন্থীদেরই প্রভাববিস্তারের সুবিধা করে দেয়। কর্নাটকে যে ছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পেল না এবং বাড়িতে বসে থাকার দণ্ডে দণ্ডিত হল নিঃসন্দেহে তাদের রাষ্ট্র ঠেলে দিল সেই গোঁড়া মোল্লাদের আওতায় যারা প্রথম থেকেই মেয়েদের স্কুলকলেজে গিয়ে পড়াশুনো করা দুচক্ষে দেখতে পারে না।

যাঁরা মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ দেবার দায় থেকে সংখ্যালঘুদেরও ছাড় পাওয়া উচিত নয় তাঁদের একটু মনে করাতে চাই যে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার দায় অর্পণ করা হয়েছে ব্যক্তিকে নয়, রাষ্ট্রকে। এবং রাষ্ট্রের কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি ঝোঁক থাকা চলবে না এই কারণেই, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাসপালনের অধিকারকে রাষ্ট্র সুরক্ষিত রাখতে পারে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অধিকারকে রক্ষা করার বিশেষ দায় সবসময়েই থেকে যায়। সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে যেখানে কোনো ধর্মীয় সংস্কারের দাবি উঠছে সেখানে তার প্রতি রাষ্ট্রকে নিশ্চয়ই সহানুভূতিশীল হতে হবে। কিন্তু কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র যখন জবরদস্তি সংখ্যালঘুর কোনো আচার-আচরণকে সংশোধন করতে চায় তখন সেখানে সংখ্যালঘুর পশ্চাৎপদতার চাইতে রাষ্ট্রের অভিসন্ধির প্রশ্নটাই বড়ো হয়ে দাঁড়ায় না কী?

4

‘হিজাব’ কি ইসলামের আবশ্যিক অঙ্গ? এ নিয়ে মুসলিমসমাজের মধ্যে নানামত আছে এবং থাকবে। শাঁখা-সিঁদুর হিন্দুত্বের অবশ্যপালনীয় আচার কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। ঠিক তেমনই একটি মেয়ে যখন শাঁখা-সিঁদুর পরে বা বাইরে বেরোনোর সময়ে হিজাব লাগায় তখন সবসময়ে হলফ করে বলা যায় না সে ধর্মীয় চোখ রাঙ্গানির ফলেই তা করছে, না মজ্জাগত পারিবারিক অভ্যাসের ধারাবাহিকতায়, না নিজের মনের খুশিতে। এইসব কিছুর বাইরে গিয়ে যদি সে নিজস্ব ইচ্ছাতেই এই আচারগুলিকে ত্যাগ করে এবং তার জন্য সমাজের কাছে লাঞ্ছিত হয় তাহলে রাষ্ট্রের অবশ্যই একটা দায় জন্মায় তার স্ব-নির্বাচনকে নিরাপত্তা দেবার। কিন্তু হিজাব পরার অজুহাতে তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকতে না দিয়ে রাষ্ট্র যদি ধর্মনিরপেক্ষতার ঢাক বাজায় তাহলে তার বিরোধিতা করা সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষেরই কর্তব্য। কেউ হয়তো বলবেন, কর্নাটকে হিজাব নিষিদ্ধ করা অনুচিত হতে পারে, কিন্তু তাতে কতটুকুই বা ক্ষতি হল? অন্যদিকে পারিবারিক আইনগুলির মধ্যে যে অবধারিত লিঙ্গ-অসাম্য রয়েছে তার প্রতিকারে সেগুলির পর্যালোচনা এবং সংবিধানের ৪৪ ধারায় প্রস্তাবিত ‘সমান দেওয়ানি বিধি’ চালু করার উদ্যোগকে আমরা কীভাবে অভিসন্ধিমূলক বলতে পারি? এখানে কি বিজেপি-আর এস এস শাসিত রাষ্ট্রের একটি ধর্মনিরপেক্ষ চেহারাই দেখা যাচ্ছে না? যে সংবিধানকে তারা খাস্তা কাগজে পরিণত করার লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছে তার একটি বিশেষ ধারা নিয়ে তাদের এত তৎপরতা কেন, উল্টোদিকে এই প্রশ্নটা করা নিশ্চয়ই জরুরি।

5

প্রথমত পারিবারিক আইনগুলিকে বিধিবদ্ধ করে তাদের যে সমান দেওয়ানি বিধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার কথা বলা হচ্ছে তার আদলটা কীরকম হবে তা নিয়ে কিন্তু কোথাও কোনো বক্তব্য সরকারপক্ষ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না; শুধু একটা আবছা ইঙ্গিত রাখা হচ্ছে যে আলাদাভাবে পারিবারিক আইন আর থাকবে না। কিন্তু ৪৪ ধারা কি পারিবারিক আইন তুলে দেবার কোনো কথা বলে? বলে না, তার কারণ সেটা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। বরং ভারতীয় আইনের ইতিহাস দেখায় পারিবারিক আইনগুলির মধ্যে ন্যায়ের যে ঘাটতি আছে (বিশেষত মেয়েদের প্রতি) তার প্রতিকারে পারিবারিক আইনের পাশাপাশিই বিভিন্ন সময়ে কিছু প্রগতিশীল আইন তৈরির সুযোগ ভারতীয় আইনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন, সিভিল বিবাহ আইন, পণপ্রথাবিরোধী আইন বা গার্হস্থ্য হিংসা থেকে মেয়েদের সুরক্ষার আইনের সুবিধা ধর্মনির্বিশেষে সব মেয়েই পেতে পারে। ডানিয়েল লতিফির মতো আইনবিদ্‌ও জানিয়েছেন যে মুসলিম মহিলা আইন চালু করে সেই মেয়েদের খোরপোষ থেকে বঞ্চিত করার চক্রান্তসত্ত্বেও তাদের ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৫ ধারা অনুযায়ী এখনো সেই সুবিধা দেওয়া সম্ভব।

পারিবারিক আইন রদ করার ভয় না দেখিয়ে সরকার কেন এই আইনগুলিকে কার্যকরী করার পদক্ষেপ নেয় না? জাতধর্ম না মেনে বিবাহিত দম্পতিদের ওপর পারিবারিক সম্মানের নামে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয় তা বন্ধ করার জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ আইন এখনো কেন আনা হচ্ছে না? অবশ্যই বিজেপি-আর এস এস সরকারের সমাজসংস্কারের বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে শরিয়তি আইনের দুটি ধারাকে ঘিরে; একটি পুরুষের বহুবিবাহ-সংক্রান্ত এবং অন্যটি মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স-সংক্রান্ত। দুটি প্রথাই আপত্তিজনক এবং তার সংশোধন হওয়া উচিত।

6

কিন্তু যাঁরা মনে করেন হিন্দু পারিবারিক আইনটিই প্রগতিশীল পারিবারিক আইনের মডেল তাঁদের কাছে প্রশ্নঃ বর্তমানে দেশে যত মুসলিম একাধিক বিবাহ করেন তার সংখ্যা খুবই কম; এক স্ত্রী পরিত্যাগ করে যত হিন্দু দ্বিতীয়ার সঙ্গে সংসার পাতেন তার চেয়ে বেশি তো নয়ই। সব মুসলিম মেয়েরই কি পনেরো বছর বয়স হলেই বিয়ে হয়ে যায়? না, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে-থাকা অশিক্ষিত হিন্দু-মুসলিম সব পরিবারেই মেয়েদের ছোটো বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়াটা একটা অভিশাপ? তাহলে গোড়ার কারণগুলিকে দূর করার ন্যূনতম চেষ্টা বাতিল করে মুসলিমদের ‘মজ্জাগত’ পশ্চাৎপদতাকেই মেয়েদের সব দুঃখদুর্দশার মূল বলে চিহ্নিত করে সমান দেওয়ানি বিধির জয়গান করাকে অভিসন্ধিমূলক বলব না কেন?

ইরান সরকার কট্টরপন্থী বলে হিজাবের পক্ষপাতী হতে পারে; কিন্তু কর্নাটকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা হিজাব নিষিদ্ধ করেছে তারা খুব প্রগতিশীল এমনটা মনে করার তাই কোনো জায়গাই নেই। একইভাবে সমান দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের প্রস্তাবের আসল উদ্দেশ্য হিন্দু আইনসহ সব পারিবারিক আইনে মেয়েদের প্রতি যে অবিচার আছে তা দূর করা নয়। সংখ্যালঘুর পারিবারিক আইনের জন্য সংবিধান যে পরিসর রেখেছে তা মুছে দেবার প্রচ্ছন্ন হুমকি রয়েছে এতে। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কুপ্রথার সংস্কারের জন্য প্রগতিশীল আন্দোলনই কোণঠাসা হবে; হিন্দুত্ববাদীদের ঘৃণার রাজনীতি ফুলে ফেঁপে ওঠার পাশাপাশি মুসলিম কট্টরপন্থীদের প্রচারও আরো বৃদ্ধি পাবে। সেই বিভাজনই বিজেপি—আর এস এস-এর প্রকৃত উদ্দেশ্য।