পদযাত্রায় যেতে যেতে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা নাজেম চাচার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। নাজেম চাচা বলেছিলেন,”একদিন  আমাদের গ্রামে চলো। “অতীতকে ফিরে দেখতে হবে। এখনকার ছেলেমেয়েরা অতীত জানে না। আমি সবাইকে জড়ো করে রাখবো।৭০ ঊর্ধ্ব বয়স নাজেম চাচার। নাজেম চাচার কথামত একদিন গ্রামে গেলাম ।সকাল থেকে কৃষক সমিতির সদস্য সংগ্রহ করা হলো ।নাজেম চাচাও সঙ্গে ছিলেন। সেই সময়কার আমাদের কৃষক সভার একজন দক্ষ সংগঠক ও কর্মী ছিলেন। সরকার চলে যাওয়ার পর দু তিনবার মার খেয়েছেন ,বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। দুতিনটি মিথ্যা মামলা আছে নাজেম চাচার নামে। কিন্তু লাল ঝান্ডার প্রতি দরদ এখনও অটুট আছে। পাড়ার লোকজন ঠিকই আছে ।ভয়ে বের হচ্ছে না। যাইহোক তাঁকে নিয়ে কৃষক সভার সদস্য সংগ্রহ করতে পাড়ায় বেরোলাম। ঘুরতে ঘুরতে অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা হল।আবাস যোজনার টাকা যাদের পাবার কথা এই রকম প্রকৃত দু – একটি ঘর দেখালেন। আবার যাদের পাবার কথা নয় তারা টাকা পেয়েছে সেই রকম ঘরও দেখালেন। প্রায় সকলেই সদস্য হচ্ছেন।আবাস যোজনার দুর্নীতি, প্রকৃত প্রাপকদের না দেওয়া ,জব কার্ডের বকেয়া টাকা শোধ না করা, এবং কাজের অভাব, খেতমজুরদের বেতন না বাড়া, শৌচাগার না পাওয়া,নানান অভিযোগ মানুষ বলছে। নাজেম চাচা বললো আজ সন্ধ্যাবেলায়  সবাইকে ডেকে রেখেছি। ছেলে ছোকরাদের থাকতে বলেছি। তখনকার সব ঘটনা আমার ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। ঐ লেখাটা পড়ে শোনাবেন। তাহলে সব বূঝতে পারবে। আসলে অতীতকে না জানলে, বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার সমস্যা যেমন থেকে যায়,তেমনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দিশাহীন হয়ে পড়ে। সেজন্য সব ডায়েরিতে লিখে রেখেছি ছেলে, মেয়ে,নাতি, নাতনিদের পড়ে শোনায়। ওরাও পড়ে।

যার জন্য আমাদের পরিবারের কেউ বিপথে যায় নি।  আপনি সেই খাতাটা পড়ে শোনাবেন তাহলেই সব বুঝতে পারবে। আসলে আপনারা  কেউ গ্রামে আসেননি? আমরাও যোগাযোগ করিনি।আর টি ভি তো মাথা খেয়ে দিচ্ছে।যার ফলে সামনে যেটা পাচ্ছে সেটাই ধরে আগাতে চাইছে। ওদেরকে বোঝাতে হবে,  অতীতের দিনগুলো কেমন ছিল। পাড়ার লোকজন পুলিশের ভয় আর কেসের ভয় পাচ্ছে। তোমরা সাহস দিলে সব বেরুবে এবং পদযাত্রাও হবে। সারাদিন কৃষক সমিতির সদস্য সংগ্রহ করার পর সন্ধ্যেবেলায় নাজেম চাচার ঘরে বসা হলো। পদযাত্রায় মোহনদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল । পাশেই মোহনদার পাড়া।মোহনদাকে খবর দেওয়ায় , দু চার জনকে নিয়ে মোহনদাও নাজেম চাচার ঘরে চলে এলেন।মোহনদাও সেকালের একজন আমাদের ভালো কর্মী। কিন্তু  বের হচ্ছে না শুধু পুলিশের ভয় ,কেসের ভয়। সন্ধ্যা বেলা বৈঠকে বসা হলো আমি গল্প করতে করতে কিছু রাজনীতির কথাবার্তা শুরু করলাম। নাজেম চাচা আমাকে থামালেন। বললেন, আমার খাতাটা পড়ে শোনাও। আমার এই খাতায় অতীতের সব ঘটনা লেখা আছে, বামফ্রন্ট সরকার গরীবদের জন্য কি করেছিল তাও লেখা আছে। আমি বললাম আপনি যা লিখে রেখেছেন এ তো ইতিহাস হয়ে যাবে।

নাজেম চাচা উত্তরে বলেন ,আরে সেটাই তো দরকার। এখনকার ছেলেমেয়েরা অতীত জানে না। আমাদের কিভাবে খাটতে হয়েছে, সংসার কিভাবে চলত সব লেখা রয়েছে।এটা ধরে পাড়ায় পাড়ায় পড়ে শোনান। এখনকার ছেলেমেয়েরা বুঝবে। অতীত সব ভুলে গেছে। তুমি পড়তে শুরু কর।নাজেম চাচা হাঁক দিল,”কইগো চা’টা দিয়ে যাও”। চা খেয়ে শুরু করবে।একটু পরেই চা এল। চা খাবার পর মোহনদা একটা বিড়ি দিল।বিড়িতে টান দিয়ে আমি পড়তে শুরু করলাম। নাজেম চাচার ডায়েরি : আমার বয়স তখন ১৬-১৭ হবে।বাবা বছর বাঁধা চাকর।(তখনকার সময়ে কৃষি মজুরদের চাকর,মুনিস বলা হত) অনেক কষ্ট করে বাবা আমাকে ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়ে বাগাল ঢুকিয়ে দিল চাষীর ঘরে পেট ভাতায়। কংগ্রেসের শাসন ১৯৭২–৭৩ সাল। চরম অভাব। বাবার বেতন ছিল ৩-৪টাকা। তাও বছর বাঁধা বলে।যারা দিন খাটতে যেত তাদের বেতন ছিল ১-২ টাকা (এদেরকে বলা হত লাগময়টে,লাগারে)। বর্ষাকালে জল হলে কোনরকমে ধান চাষটা হত। যেখানে পুকুর, দিঘি থাকত তার চারপাশের জমিতে আলু,সরসে,রাঙালু, অন্যান্য সবজি চাষ হতো। তাও সেচন রেকর্ড থাকলে তবেই চাষ হতো। ডোঙা,সিমলি দিয়ে জল ছিঁচতে হত। রাত তিনটা -চারটায় হাল বার করতে হতো।

বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা ৮-৯টা বাজত। বাবা খেটে খেটে অসুখে ভুগতে লাগল।ভুগে ভুগে বিনা  চিকিৎসায় বাবা মারা গেল। বেশ কিছুদিন কাজে যায নি।বাবু ধমক দিয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন,”না গেলে গলায় গামছা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাব”। তখনকার দিনে দুতিনদিন কামাই হলে মনিবরা ঐভাবেই নিয়ে যেত। বাবা অনেক কষ্ট করে একটা ছোট রেডিও কিনেছিল।রেডিওর খবরে শুনতুম দেশে খুব গন্ডগোল হচ্ছে। খাবারের অভাব, লেভীর জুলুম,স্কুল কলেজের বেতন বাড়ানো, রাস্তাঘাটের সমস্যা,লেভীর জুলুম বন্ধ করা, জমিতে সেচের দাবি,এই সব নিয়ে বামপন্থীরা আন্দোলন করছে। তারপর শুরু হয়েছে খুন খারাপি।নকশাল নামে একটা দল জমিদার,মহাজন, সুদখোর সব মানুষদের গলা কাটছে। আমাদের পাশের গ্রামে একজন মহাজন খুন হয়ে গেল। গোটা রাজ্যে কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলন করছে। তারপর এল ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচনে বামফ্রন্ট জিতে গেল ও সরকার গঠন করল।জ্যোতি বসু হলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঘোষণা করলেন,”বিনা বেতনে ছেলে মেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া শিখতে পারবে, সেচের ব্যবস্থা করা হবে,জমির খাজনা মুকুব করা হবে (গরীব ও মাঝারি কৃষকদের), পঞ্চায়েত নির্বাচন করা হবে, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যা জমি রাখতে পারবে কিন্তু বাড়তি জমি ভূমিহীনদের দেওয়া হবে। কংগ্রেস সরকারের মজুরি আইন, ৮ টাকা ১০ পয়সার দাবিতে মজুররা আন্দোলন করবে, পুলিশ ধর্মঘট ভাঙতে যাবে না। রাত হল, মোহনদা বলল আজ এখানেই থাক। পরের দিন আবার পড়া হবে। আমরা পদযাত্রার প্রস্তুতি শুরু করি। পদযাত্রার দুদিন আগে আবার নাজেম চাচার ডাইরি পড়া হবে। শেষে চা খেয়ে আশায় বুক বেঁধে, গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরলাম।                                                                                                         চলবে…