শাস্ত্রীয় কলিযুগ ও তৃণমূলী টলিযুগ

গৌতম কর

রাজা বাদশাহদের হারেম ছিল, জমিদারের ছিল বাগানবাড়ি, বড়বাবুর নাইটক্লাব। বহু ধর্মগ্রন্হের পরেও মানবধর্মের বদল হয়নি, রূপান্তরিত হয়েছে। এমনকি অনেক সাধক এই শেষ বাধা অতিক্রম করতে না পারায় বিশ্বে ধর্মের সংখ্যা বাড়েনি। সুলতান, নবাব, গোমস্তাদের তুলনামূলক ভাল মন্দ থাকতে পারে। ইতিহাস তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। বাদশাহ আকবরের হারেমে পাঁচ শতাধিক নারী তাঁর মহান হওয়ার অন্তরায় হয়নি। শাহজাহান মুমতাজ মহলের মৃত্যুর পরেও শাদি করে বিশ্বপ্রেমিক উষ্ণীষ বহন করেছেন। বাঙালীরা জমিদার বাড়ির পুজো, সেরেস্তার খাজনা, বাবুর বাগানবাড়ি জানে। ভূতের কৃপায় এখনও নাকি নিশুতি রাতে ঘুঙুরের শব্দ শোনা যায়। নিকী, আশরুন, ফৈয়াজবক্স, বেগমজান, হিঙ্গুল, নান্নিজান, সুপনজান, জিন্নাতরা শোভাবাজার, চোরাবাগান, বটতলা, মাণিকতলা মাতিয়ে রেখেছিলেন। রেশনের লাইনে জনতার পূর্বপুরুষ জৌলুস চাক্ষুষ করেনি, ভূতের গল্পই ভরসা। সাহেবরা দুর্গা পুজোয় আসতেন বাঈজী নাচ দেখতে। নবাবী উৎসবে মাতোয়ারা। তবলচির হাত নাচত নর্তকীর নাচের ছন্দে।

বৈভবের সাথে নিশা, নারী ও সুরা যেমন যুক্ত তেমন বৈভব রক্ষার্থেও যুগোপযোগী। আজও নাইটক্লাবে ক্যাবারে নাচের আসলে কর্পোরেট হাঙর ক্লায়েন্টের সাথে টুক করে বিজনেস ডিল সেরে ফেলেন। অর্থ প্রাচুর্য বদরক্তের মত বেরিয়ে যেতে চায়। বন্টনের অসাম্যের প্রথম উপসর্গ এই বদরক্ত। প্রজাতন্ত্র দিবসে কুচকাওয়াচ অভ্যাসের সময়ে এক জওয়ানকে আমীরপুত্র দামী গাড়ির তলায় পিষে দেবে। সেক্সপীয়র সরণীতে বিলাসবহুল দ্রুত গাড়িতে মধ্য রাতে নাবালক শাহজাদা তিন জনকে অনায়াসে হত্যা করে। হাঁসখালীর কিশোরীকে নেতার সুপুত্র ধর্ষণ করে পুড়িয়ে দিলেও মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস পায়, গর্ভবতী ছিল মেয়েটি। নতুন অসুখের বাজারে ওষুধ দ্রুত আসে। পনেরো বছরে বাংলা জুড়ে বহু রিসর্টের জমজমাট আসর। প্রশাসন মালিক ও খদ্দেরদের চেনে। এমনকি কিছু লোকের হাতে হারামের পয়সার কাহিনীও অজানা নয়। চিটফান্ড থেকে শুরু করে নারদ, শিক্ষায় দূর্নীতি, নিয়োগে ঘুষ, বালি-কয়লা-গরু-মাটি থেকে শিশু-নারী পাচারের বদরক্ত সবটা সাদা করা যায় না। বমনের জন্য ফুল বাগানে নর্দমা দরকার।

ফুলের বাগানে মৌমাছি, প্রজাপতি আসবেই। বিজ্ঞাপন দিয়ে অথবা আমন্ত্রণ পাঠিয়ে ডাকতে হয় না। উন্নয়নকামীরা রাণী মৌমাছিকে ঘিরে মধুর চাক বানিয়ে ফেলে। সুন্দরী থেকে শার্প শ্যুটার, বাউন্সার মধুপুষ্ট করে। ওরা দেখতে পায় শস্তার উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির বউ থেকে মডেলিংএ ভাগ্য পরীক্ষায় আসা তন্বী মই খুঁজতে থাকে। কেউ আঁধারে হারিয়ে যায়, কেউ সত্তরোর্ধ মন্ত্রীর টাকার গদিতে যৌবন বেচে। লেনদেনে লাভক্ষতি চিরকাল ছিল। দ্বিতীয় শ্রেণীর অভিনেত্রী অভিজাত আবাসনে তিনটি ফ্ল্যাট এক করে ফেলে, কেউ একটি ফ্ল্যাটের তিনটি ঘরে ব্যবসা জমায়। ওরা জানে, বিপুল পৃথিবীর খুব আঁধারে কদাচিৎ আলো পড়ে, বাকিটা অনুচ্চারিত থেকে যায়। সুরা ও নারীর গন্ধে মাতাল বোম-বন্দুক আসবেই। পঞ্চায়েত সদস্যের পাঁচ তলা বাড়ি দেখে চ্যালেঞ্জার ঘোড়া টিপে দেয়। আমরা গতানুগতিক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর পড়ি। এই চক্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয় রূপালী পর্দার নায়ক-নায়িকারা। উথ্থান দ্রুত। নেক নজরে পড়লে নির্বাচনের টিকিট। শাসক জানে, মানুষের ঘরে আয়না নেই, চকচকে গাল দেখে।

উঠতি বা পড়ন্ত বিকেলের শিল্পীদের বৈভবের দ্যূতিময় বৃত্ত অব্যর্থ পাসপোর্ট। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে। শান্তনুদের মধুচক্রের মহামানবের মিলনতীর্থে। যাদের হাতে বিপুল অর্থ তারা থেঁতলে যাওয়া জনগনকে ক্ষমতা দেখায় – দ্য বিষ্ট অ্যান্ড দ্য বিউটি। মঞ্চ আলোকিত করে উপস্হিত হয়। বিনিময়ে ডন বিনিয়োগ করে টলি ইন্ডাস্ট্রিতে। দ্বিতীয় শ্রেণীর নায়িকা নাম ভূমিকায় সুযোগ যেমন পায়, মডেল চলে আসে পার্শ্ব চরিত্রে। বাইরের থেকে যতটা মসৃণ মনে হয়, ততটা নয়। হয়ত অতিক্রম করে শারীরিক রুক্ষ এজমালি মরুভূমি। ২১শে জুলাই বৃষ্টি ভেজা মঞ্চে ডাইরেক্ট টেলিকাস্ট, রোড শো। টিকিট পেলে লটারির নয়া পর্ব।  যাদের জীবনটাই মেকাআপ ব্লেন্ড, স্বর্ণালী শিমার থেকে নেলআর্টে বা লাইট, অ্যাকশন, সাউন্ড, রিটেক, লেখা ডায়ালগে তারা ভাববে দেশের ভবিষ্যৎ, অর্থনীতির খানাখন্দ। যেখানে মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত নয়, সেখানে তারা ভেবে করবে কী? বিধানসভা বা সংসদে বছরে একবার হাজিরা দিয়ে সেল্ফি পোষ্ট করতে পারলেই কেল্লা ফতে। টলিউডে ফ্যান বাড়বে।

ওদের বোঝানো হয়, রাজনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, ভবিষ্যৎ, অর্থ-ব্যবস্হা এসব না জানলেও চলবে। তোমার ত্বচা কথা বলবে। নেত্রীর ছবির নিচে। সব কেন্দ্রে প্রার্থী একজন। তিনিই সব জানেন। এমনকি যারা মেনস্ট্রিম রাজনীতির প্রোডাক্ট, তারা কেবল কাটমানির ক্যুরিয়ার বয়। ওয়ান ম্যান শো। উন্নয়নে থাকতে দুধেল গরুর লাথির বিনিময়ে নোটের স্তূপ। সুলতানদের হারেমে বেগমরাও পেছন থেকে সুতো নাড়াতেন। চারপাশের উন্নয়নে বিশ্বাস করতে হবে। সেই দেশপ্রেমিকরা নির্দিষ্ট সময়ের পর দেশপ্রেমের চৌহদ্দিতে বেহদিশ হয়ে যায়। তিনি মুনমুন সেন হন বা দেবশ্রী রায়। কেউ কেউ বাকি জীবনের অবসর বিনোদনের বিকল্প পথ হিসাবে দেখে। টিকিট অবধি পৌঁছাতেও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, শয্যাবিলাসী হতে হয়। টিকিটের চাহিদা প্রচুর, তীব্রতর প্রতিযোগিতা। গরীবের আদেখলে চাহিদা সমুদ্রের মত যৌনগন্ধী। সিনেমা হলে দেখতে টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়, ভোট দিলে এমনিতেই দেখার প্রত্যাশা। কচি-বুড়ো অদেখা দেখতে লকলক করে। নেলআর্ট ব্যবসায়ী সদম্ভে বলেন, কুন্তল আমার সব দেখে টাকা দিয়েছে।

দক্ষিণ ভারতে রূপালী পর্দার দাপট আগেও ছিল। প্রগতিশীল বাংলায় এমনটা ভাবা যেত না। হঠাৎ জনৈক ব্যক্তি শাসক দলের সাধক হয়ে গেলেন কিংবা ভক্তরসে আপ্লুত। আসলে দলের মালিকরা শর্ট কাটে জিততে চান। রূপালী পর্দার খেলোয়াড়রাও হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না। রাতের আঁধারে জার্সি বদলে তাজ্জব করে দিতে পারেন। বাঙালীবাবু দল বদল করলে বিহারীবাবু শূণ্যস্হান পূরণ করবেন বা হাফপ্যান্ট মন্ত্রী ফুলপ্যান্ট পেলে ট্রাপিজের খেলা দেখাবেন। সামগ্রিক রাজনৈতিক চেতনার অবক্ষয়। এই পতনটা শাসকের মূল নীলনক্সা মাফিক। এঁরা মঞ্চে নাচলে পেছনে চলবে হাতসাফাইয়ের খেলা। চাকরি বিক্রী হয়ে যাবে, বাংলার সম্পদ উড়ে যাবে ব্যাঙ্কক, লন্ডনের ব্যাঙ্ক, ভানাতুতে। কার্নিভালে মত্ত মাতাল কাঁসর বাজাবে উন্নয়নের। জমিদারবাবুরা ঠিক যে কারণে দুর্গা পুজোয় বাঈজী নাচের আসর বসাতেন, ঠিক সেই কারণেই টলিউড দখল নিচ্ছে বাংলার ভবিষ্যৎ। ফলতঃ যেমন ধ্বংস হচ্ছে রাজ্য, ঠিক তেমন খন্ডহর হয়ে যাচ্ছে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিকের চলচ্চিত্র ভাবনার চালচিত্র। বনি-শনিদের দাপট বাড়ে।

বাংলা কষ্ট করে ফিল্ম বানিয়ে অস্কার এনেছে, এখন অর্থের প্রাচুর্য আর অস্কার যায় দক্ষিণে। তদন্তকারী সংস্হাগুলো জনৈকা সোমা রূপশিল্পীর পঞ্চাশ লাখ ফেরৎ চায় বা আধা নায়িকার তিন এক্কে এক ফ্ল্যাট। এটা তো টলি-বনিদের উপার্জন। উপভোক্তা কোন পথে সে অর্থ আয় করেছে সেটা দেখুন। সে খদ্দেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি বা খদ্দেরেও সন্তুষ্টির খামতির কথা বলেনি। প্রযোজকের ছবি ফ্লপ করলে কি অভিনেতা পারিশ্রমিক ফেরৎ দেয়? তারা রূপ-যৌবন-পরিশ্রম ঢেলে কাজ করে। লেনদেনেই টলিযুগের স্বর্ণযুগ। অরূপ রতন পেতে এই স্বরূপে বিশ্বাস করতে হবে। গ্রীষ্মকালে কাঁঠাল, লিচু, আম কাটলে মাছি আসবেই। ওই রস সরিয়ে ফেলতে হবে। দূর্নীতি বন্ধ হলে, বদরক্তের নৈশ জীবনে মদ মাংসের আসর বন্ধ হবে। মদ মাংস বন্ধ হলে মৌমাছি প্রজাপতি সমাগম হবে না। টলিপাড়া থেকে কেউ উড়ে আসবে না মধু খেতে। কোন দেব বা দেবী গাঁটের কড়ি খরচ করে সমাজসেবা করে না। কোন উত্তম কুমার এমনকি অধম কুমারের দায় পড়েনি জনতার ডায়ালগ ঝাড়তে। নেত্রীরও শাহরুখ প্রীতি কমাতে হবে।

শাহরুখকে সোনার হার পরিয়ে বাংলার কোন লাভ নেই। রাজ্যের কোষাগার খসিয়ে নেত্রীর টিআরপি বাড়ে। অন্য নেতা চন্দ্রহার দিলে তার ফিসফ্রাই খাবেন। তাহলে কি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাজনীতির ময়দানে আসবেন না? অবশ্যই আসবেন, তাঁদের মৌলিক চিন্তাভাবনা আদান প্রদান করবেন, দরকারে নির্বাচনে দাঁড়াবেন। ছবি হয়ে নয়, ছবি বদলাতে। খানসামা, পাইক, পেয়াদা চাই না, বাদাশা হলে মন্দ হয় না। কণ্যাশ্রী-রূপশ্রীর ভাঁওতা না দেওয়া শ্রীলেখার কথা লেখা যেতে পারে, কিংবা প্রত্যাশিত বিপ্লব। তবু এমন কোন চোর নয়, যাকে সমাজ ও রাজনীতি ব্রাত্য করে দেবে। যেদিন দেখবেন, টলিপাড়া থেকে টালির বাড়ির দিকে মাছি উড়ছে না, সেদিন বুঝবেন দূর্নীতির বদরক্ত কম। কাঁঠাল, আমের গন্ধ সরিয়ে ফেলুন, নৈশ পার্টি, যৌনতা, মদ, হুল্লোড় সরে গেলে রসাতল দূরে হয়ে যাবে। রূপ ব্যবসায়ীদের বাজার চলুক সান্ধ্য সিরিয়ালে কিংবা মাল্টিপ্লেক্সে। শিল্প সন্ধানীরা কফি হাউসের আড্ডায়। বাঙালী মত্ত থাক রবিবাসরীয় মাংসের ঝোল, সন্তানের শিক্ষা, যোগ্যতায় চাকরি, শারদীয়া উপন্যাসের নয়া আনন্দে।