পশ্চিমবঙ্গের  তৃণমূল কংগ্রেসের তৃতীয় দফার  সরকারের  দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি হলো গত ২ রা মে। “বদলা নয় বদল চাই ” শ্লোগান তুলে সরকারে এলেও তৃণমূল সরকারের মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী  প্রথম থেকেই তাঁর সমালোচকদের সমান্তরালভাবে রাজনৈতিক ও  পুলিশী হেনস্থা করা শুরু করেছিলেন। অধ‍্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র থেকে কামদুনির মাস্টারমশাই প্রদীপ মুখার্জী গৃহবধূ মৌসুমী কয়াল ও টুম্পা কয়াল হয়ে কৃষক শিলাদিত‍্য চৌধুরী হয়ে ছাত্র নেতা শহীদ  সুদীপ্ত গুপ্ত সহ অনেক নামের ভিড় উঠে আসবে এই এগারো বছরের কিছু বেশি সময়ের ইতিহাস ঘাঁটলে। তারও আগের ইতিহাসে ফিরে তাকালেও দেখা যাবে ক্ষমতায় আসার জন‍্য নৈরাজ্যের রাজনীতির পাশাপাশি  মৃতদেহ নিয়ে নেতিবাচক আন্দোলন ও  ব‍্যক্তিহত‍্যার রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছেন মমতা ব‍্যানার্জী। ১৯৯৩ সালের ২১ শে জুলাই থেকেই এই অভ‍্যাস তাঁর রয়েছে। ২০০৭ সালে সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের সময় রহস‍্যজনকভাবে মৃত তাপসী মালিকের দগ্ধ দেহের ছবি পোস্টারে ছাপিয়ে সিপিআই(এম) বিরোধী প্রচার শুরু করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। মিথ‍্যা অভিযোগ করে গ্রেফতার করা হয়েছিল প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা সুহৃদ দত্তকে। সেই সব অপপ্রচার ও নেতিবাচক রাজনীতিকে সমর্থন  করেছিল বাজারি মিডিয়া। চিটফাণ্ডের টাকায় প্রকাশিত হচ্ছিল বেশ কিছু পত্রিকা ও চালু হয়েছিল কিছু টেলিভিশন চ‍্যানেল। তাদের  সবার কাছেই সিপিআই(এম) এর নেতা কর্মীরা সবাই “হার্মাদ”। নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সময় শুধুমাত্র  ২০০৭ সালেই  শঙ্কর সামন্ত সহ উনত্রিশ জন বামপন্থী কর্মী খুন হয়েছিলেন সন্ত্রাস কায়েমের স্বার্থে। দুই ছাত্রী সুমিতা সামন্ত ও দীপান্বিতা জানার হত‍্যাও এই  সময়ের ঘটনা। খুন করে তালপাটি খালে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল পুলিশ অফিসার  সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লাশ। এই নির্বিচারে হত‍্যাকাণ্ড সংঘটিত করার জন‍্যই

তথাকথিত মাওবাদী দের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। যাদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল জমানা শুরু হতেই নির্ভেজাল তৃণমূল কংগ্রেসীতে রূপান্তরিত হয়েছে।  তথাকথিত আগুনখেকো মানবাধিকারকর্মীরা এখন ক্বচিৎ কদাচিৎ মিডিয়াতে মুখ খুললেও বছর পনেরো আগে তাঁরা “বামফ্রন্ট সরকারের প্ররোচনায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস” এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে  সোচ্চার হতেন,আজকের শাসকদলের মিছিলে ভিড় বাড়ানোর পাশাপাশি নিজেরাও মিছিল অবস্থান ইত‍্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করতেন। কিন্তু এখন তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে ব‍্যক্তিহত‍্যার রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁরা নীরব।

 ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি তে চলে গিয়ে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে মমতা ব‍্যানার্জীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা শুভেন্দু অধিকারীকে “নন্দীগ্রামের সন্ত্রাসের নায়ক ” হিসাবে চিহ্নিত করে ২০০৭ সালের ১৪ ই মার্চের গুলিচালনার ঘটনার জন‍্য দায়ী করে ২০২১ সালের ২৯শে মার্চ  রেয়াপাড়ায় এক জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন,যা টিভি চ‍্যানেলে সম্প্রচারিত হওয়ার পর হৈ চৈ পড়ে যায়। কারণ নন্দীগ্রামের সন্ত্রাস যা তৎকালীন রাজ‍্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর “হাড় হিম” করে দিয়েছিল -তার জন‍্য মমতা ব‍্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন  তৃণমূল কংগ্রেস সহ বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধী দলগুলো বিশেষভাবে সিপিআই(এম) কে দায়ী করে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটানোর ডাক দেয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলি, বুদ্ধিজীবীরা নন্দীগ্রামের ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিদর্শন হিসাবে চিহ্নিত করে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। কিন্তু  ১৪ বছর পর মমতা ব‍্যানার্জী নন্দীগ্রামে গুলিচালনায় তখন  সদ্য তৃনমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার শুভেন্দু অধিকারী ও তার বাবা শিশির অধিকারীকৈ কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ফলে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছিল। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশি অভিযানের জন্য নাম না করে শিশির অধিকারী এবং শুভেন্দু অধিকারীকে দায়ী করেন। এমনকি, হাওয়াই চটি-পরা পুলিশ ঢোকানোর ‘দায়’ও চাপিয়ে দেন তাঁদের ঘাড়ে। যদিও শিশির অধিকারী এই বক্তব্যে  তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘‘ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে!’’ ঘটনাচক্রে, এই মমতা  বক্তব্য রাখার কয়েক মাস আগেও শুভেন্দু এবং কয়েক দিন আগে শিশির তৃণমূলেই ছিলেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তাঁরা ‘সক্রিয়’ ভূমিকাও পালন করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি-তে এবং তাঁর বাবা শিশির অধিকারী সরকারি ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ হলেও দলের সঙ্গে ব‍্যাপক দূরত্ব বজায় রেখেছেন বিধানসভা ভোটের পর থেকেই। কিন্তু ২০০৭ সালে  শিশির-শুভেন্দু এবং মমতা— তিনজনেই তো তখন বিরোধী তৃণমূলে ছিলেন। প্রাক্তন  মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এই গুলিচালনার ঘটনার পিছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে বলা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয় নি। নন্দীগ্রামের ঘটনায় ১৪ জনের প্রাণহানির পর তাঁদের সেই স্বর চাপা পড়ে যায়।

কি বলেছিলেন নন্দীগ্রাম বিধানসভা নির্বাচনকেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মমতা ব‍্যানার্জী? ‘‘যারা গুলি চালিয়েছিল আপনাদের মনে আছে, পুলিশের ড্রেস পরে এসেছিল অনেকে। মনে আছে? মনে পড়ছে? অনেকে পুলিশের ড্রেস পরে এসেছিল। নিশ্চয়ই ভুলে যাননি! নন্দীগ্রাম, নন্দীমা, আমার মনে আছে সব। আমি ডেট ওয়াইজে বলে দেব। মনে আছে, হাওয়াই চটি পরে এসেছিল বলে ধরা পড়ে গিয়েছিল। এ বারেও সেই সব কেলেঙ্কারি করছে। অনেক বিএসএফ, সিআইএসএফ-এর ড্রেস-ট্রেস কিনেছেন। কারণ, যাঁরা এ সব করেন না তাঁরা জানেন। আর আমি এখনও বিশ্বাস করি, আমি পরে শুনেছিলাম, এই বাপ-ব্যাটার পারমিশন ছাড়া সে দিন পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। আমিও একটা গভর্নমেন্ট চালাই। আমিও খোঁজখবর পরে নিয়েছি। দেখুন, আমি ভদ্রলোক বলে কিছু বলিনি। ফেয়ার এনাফ!’’

মমতা ব‍্যানার্জীর এহেন বোমা ফাটানো বিবৃতিতে বিশেষ কোন প্রভাব পড়েনি গত২০২১ সালের বিধানসভা  নির্বাচনে। বরং ধর্ম নিয়ে বিভাজনের রাজনীতির কারণে রুটি রুজির আন্দোলন পিছনে সরে যায় বামপন্থী ও কংগ্রেসের বিপর্যয় ঘটে। তৃণমূল বিজেপি ছাড়া ভাঙড়ে একটিই আসনে জেতেন আই এস এফ প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকী। কিন্তু ২০০৭ সালের ১৪ ই মার্চ নন্দীগ্রামে যে  ১৪ জন নিহত হয়েছিলেন,সিবিআই রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁদের সাতজন গুলিতে নিহত হলেও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল বোমার স্পিলিন্টারে। এই রহস‍্যভেদও আজ তত প্রয়োজনীয় মনে না ও হতে পারে। কিন্তু এই সত‍্য এড়ানো যাবে না যে তৃণমূল কংগ্রেস লাশের রাজনীতিতে ভর করে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস।

১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রামের গরীব মানুষের মধ‍্যে বিদ্বেষের রাজনীতি  ছড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। কখনও ধান কাটা,কখনও জমি বিবাদ কখনও রাজনৈতিক দখলদারি কখনও বা নিশ্চিতভাবেই ব‍্যক্তিগত শত্রুতা – ব‍্যক্তিহত‍্যার রাজনীতি বিজেপির হাত ধরে তৈরি হওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মগত  বৈশিষ্ট্য। এই সময়ে প্রধান বিরোধী দল বিজেপির সংগঠন বেড়েছে প্রধানত তৃণমূল ছেড়ে আসা নেতা কর্মীদের ভরসায়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত বিজেপি তৃণমূল দুপক্ষই এখন চায় প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীকে ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখতে। বগটুইয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের একপক্ষ অন‍্যপক্ষকে সপরিবারে পুড়িয়ে মেরেছেন।  গত বারোই এপ্রিলে দুর্গাপুরে রাজ‍্যসভাপতি ডঃ সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বে বিজেপির  মিছিলে এক নেত্রীকে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়।

আসলে জীবন জীবিকার সামাজিক সুরক্ষার  অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার ঐক্যবদ্ধ লড়াইএর মোকাবিলা করা যাদের পক্ষে কঠিন তারাই খেটে খাওয়া মানুষের মধ‍্যে মধ‍্যে ধর্ম,জাতি ও ক্ষুদ্র স্বার্থে লড়াই বাধিয়ে দেওয়ার সহজতর কাজটা তারাই করে। তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির ব‍্যক্তিহত‍্যার রাজনীতিও তার অঙ্গ।