আগে দেখতাম দক্ষিণ ভারতের বিচ গুলোতে পর্যটকদের জন্য ৫-১০ টাকা দিলে পছন্দের সিনেমার আর্টিস্ট বা খেলার জগতের নায়কের কাট আউটের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ থাকত। এখন হয়েছে মোদির সঙ্গে সেলফি তোলার বন্দোবস্ত, তাও সরকারি খরচে। রেলস্টেশন বিমানবন্দরে ছয় সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ করে থ্রিডি সেলফি সেন্টার তৈরি হচ্ছে মোদির বিজ্ঞাপনের জন্য। মাঝে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতেও ইউজিসি থেকে ফরমান জারি করা হয়েছিল এ ধরনের ‘মোদি সেলফি সেন্টার’ তৈরি করার জন্য, স্বাধীন ভারতে অতীতে কখনো যা হয়নি। ভাবখানা এই, সবটাই ‘তেনার’ ক্রেডিট। ভোট যত এগিয়ে আসছে বিজ্ঞাপনের বহর তত বাড়ছে। সারা দেশে মোদী আর পশ্চিমবঙ্গে মমতা– বিজ্ঞাপনে একেবারে ‘ম ম’ করছে!

গতবছর লোকসভার প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে জানা গেল ২০১৪ থেকে ২২ সাল পর্যন্ত মোদি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক শুধু বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছে ৬৪৯১ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। মোট ৭০৮২ টি সংবাদপত্র এবং ৫০৪ টি টিভি চ্যানেলে এই টাকা দেওয়া হয়েছে। কেন সংবাদমাধ্যম মোদির এত গুণমুগ্ধ এর থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এর বাইরে অন্যান্য দপ্তরের বিজ্ঞাপন ও নানা জায়গায় বিশাল বিশাল হোর্ডিং কাটআউট– এসব তো আছেই, যার খরচ আলাদা। এখন ভোট যত এগিয়ে আসছে সেই সরকারি বিজ্ঞাপনের ঝড় বইতে শুরু করেছে। এর পেছনে কত হাজার কোটি টাকা নতুন করে খরচ হচ্ছে তা জানা যাবে আগামী দিনে। অথচ এই টাকা দেশের গরীব মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যেতে পারত। তার বদলে রঙচঙে মোড়কে মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচারের মাধ্যমে লোক ঠকানোর মোহজাল তৈরি হচ্ছে সর্বত্র। কিন্তু এভাবে বেশিদিন প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা যাবে না।

২০২৩ এর নভেম্বরে প্রকাশিত ইউএনডিপির এশিয়া- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট- ২০২৪-এ বলা হয়েছে, ভারত মাথাপিছু উচ্চ আয়-এর দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলির সাথে প্রথম সারিতে চলে এলেও আয় ও সম্পদ বন্টনের প্রশ্নে এখনো এদেশে চরম বৈষম্য বর্তমান। সরকারি বিজ্ঞাপনে শেষের অংশটি বাদ দিয়ে শুধু প্রথম অংশটি বলা হয় প্রকৃত চিত্র আড়াল করতে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ মোট জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশ ভোগ করেন এবং এরমধ্যে সর্বোচ্চ এক শতাংশ জাতীয় আয়ের ২২ শতাংশ ভোগ করেন। সর্বাধিক ১০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের ৬৫ শতাংশ ভোগ করেন। সরকারি বিজ্ঞাপনে বারবার ভারতের জিডিপির হার বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। সাথে এটা বলা হচ্ছে না এতে এদেশের গরিব মানুষের ভাগ কতটা? একটি উদাহরণ দিলে খানিকটা পরিষ্কার হবে বিষয়টি। গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ, মহিলা ও শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচটি জরুরী সরকারি প্রকল্প হল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, মিড ডে মিল, সুসংহত শিশু উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রধানমন্ত্রী মাতৃ-বন্দনা যোজনা ও বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। প্রকৃত তথ্য হল, মোদি সরকারের আমলে এই পাঁচটি জরুরী প্রকল্পে জিডিপির ০.৫ শতাংশের বেশি বরাদ্দ হয়নি। অথচ এর সাথে দেশের একটা বড় অংশ অসহায় গরিব মানুষ ও তার পরিবারের স্বার্থ জড়িয়ে আছে।

সরকার দাবি করছে, ২০২৩-২৪ সালে দেশের গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৭.৩ শতাংশ যা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের থেকেও বেশি। এভাবে দ্রুত হারে এগোতে থাকলে ভারত নাকি ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। কত ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি হবে তাও বলা হচ্ছে! ভারতীয় জনগণের প্রকৃত আর্থিক সামাজিক অবস্থার চিত্র কিন্তু এই তথ্যের সঙ্গে মেলে না। কোভিড-উত্তর কালে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত উভয় অংশের মানুষের আয় ও সম্পদ ব্যাপক হারে কমেছে। অন্যদিকে গত দশ বছরে দৈনিক দেড়শ টাকা বা তার কম( দু ডলার) আয় করেন এমন হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা গুণিতক হারে বাড়ছে। এই বৈষম্যের যন্ত্রণা আড়াল করতে মোদি সরকার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মিথ্যার বেসাতি করছে।

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য শিক্ষা সহ জনকল্যাণ প্রকল্পে সাফল্যের প্রশ্নে যাই দাবি করুক না কেন, প্রকৃত চিত্র হলো– গতবছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার প্রায় আট হাজার কোটি টাকা কম খরচ করেছে সরকার। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ টাকার মধ্যে প্রায় ৯৫০০ কোটি টাকা খরচই করতে পারেনি মোদি সরকার। দুটি ক্ষেত্রই বেসরকারি হাতে তুলে দিতে সরকারি বরাদ্দ ও ব্যয় –দুই কমছে। তাই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটি ক্ষেত্রেই চরম বেহাল দশা।

মোদি সরকার যে কর্মসংস্থানের দাবি করছে তার কতটা স্থায়ী বেতনভুক তার কোন হিসেব তারা দেয় না। উল্টে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত নির্দিষ্ট মজুরি বা কাজের নিরাপত্তা না থাকা শ্রমিকদের সংখ্যাকে সরকার স্থায়ী কর্মসংস্থান হিসেবে দেখায়। সেন্টার পর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে বেকারির হার গত অক্টোবর মাসে ছিল ৯.৪ শতাংশ, নভেম্বর মাসে ৯.২ শতাংশ। ডিসেম্বর ২০২৩এ তা সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৯ শতাংশে। অর্থাৎ এদেশে বেকারির গড় হারের চিত্রটি এখন ৯ শতাংশের আশেপাশে থাকছে যা আদৌ অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশ্নে সন্তোষজনক তথ্য নয়। ২০২৩ এর শেষের দিকে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত একটি সমীক্ষার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩– এই এক বছরের এর মধ্যে ভারতবর্ষের ২১টি বড় রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ১২টিতে কর্মসংস্থানের গুণগত মানের অবনতি ঘটেছে। এর কারণ এইসব রাজ্যে এই সময়ে স্থায়ী বেতনভুক কর্মচারীর সংখ্যা বিপজ্জনক হারে কমে অস্থায়ী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে।

রিপোর্ট বলছে, সরকারি বেসরকারি সর্বত্র সংগঠিত ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বেতনে কর্মরত স্থায়ীভাবে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা গত আর্থিক বছরে ২১.৫ শতাংশ থেকে কমে ২০.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে মহিলা কর্মীর সংখ্যা গত চার বছরে ২১.৯ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৫.৯ শতাংশ। কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে নিবন্ধীকৃত কর্মীর সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে গত দুবছরে কমেছে যা আরও একটি প্রমাণ। কর্মসংস্থানের প্রশ্নে আরো একটি বিপজ্জনক তথ্য হল, ধারাবাহিকভাবে উচ্চ আয়ের উৎপাদন ক্ষেত্রে নিযুক্তি কমে তুলনামূলকভাবে কম আয়ের কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্তি বাড়ছে। ২০২২-২৩ সালে উৎপাদন ক্ষেত্রে নিযুক্তি ১২.১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১১.৪ শতাংশ আর কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্তি ৪৪.১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫.৮ শতাংশ। ‘নোকরি জব স্পিক ইনডেক্স’-এর তথ্য থেকে জানা যায়, গত এক বছরে ভারতে উচ্চ আয়ের নিযুক্তির সংখ্যা প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গেছে। কলকাতা, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, পুনে, হায়দরাবাদের মত মেট্রো শহরগুলিতে এই কমার হার প্রায় ২৩- থেকে ২৪ শতাংশ।

পাশাপাশি অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের ন্যূনতম নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবার কোন তাগিদ এই সরকারের নেই। দেশজোড়া ভয়াবহ এই বেরোজগারি ও স্বল্পমজুরির কাজের যন্ত্রণাকে আড়াল করতে ‘বিকশিত ভারতের’ বিজ্ঞাপনের মোড়কে শঠতার আশ্রয় নিয়েছে মোদি সরকার। অথচ, নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার। সেই হিসেবে ২০১৪ থেকে ২৪– দশ বছরে অন্তত ২০ কোটি বেকারের কাজ পাওয়ার কথা। এখন সেই হিসেব মেলানোর পালা। এখন শুধু মীনাক্ষী-ধ্রুব-কলতানরা ইনসাফ যাত্রা থেকে আওয়াজ তুলছে তাই নয়, এদেশের শিক্ষিত স্নাতক যুবক যুবতীদের প্রায় ৪০ শতাংশ এটা মনে করে যে এই মুহূর্তে বেরোজগারি হল দেশের সবচাইতে বড় সমস্যা। মোদি সরকার এই প্রশ্নে সম্পূর্ণ উদাসীন।

এখন এ দেশে মূল্যবৃদ্ধি (যার গড় হার ৫.৬৯ শতাংশ) আরেকটি বড় সমস্যা যা আমজনতাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বাজারদরের তুলনায় মানুষের আয় প্রতিদিন কমছে, ফলে ক্রয় ক্ষমতাও কমছে। ক্রিশিলের সম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে, এদেশে গত এক বছরে ডাল, তেল শাকসবজি, পেঁয়াজ, টমেটো ইত্যাদির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় নিরামিষ থালির খরচ প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ওষুধের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিজ্ঞাপনে যতই ‘উজলা মায়ের’ হাসি মুখ দেখানো হোক না কেন, সবাই জানে ভোট মিটলেই আবার গ্যাসের দাম তরতরিয়ে বাড়বে। পেট্রোল-ডিজেলের দাম তো পাম্পের মিটারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেল পিছু দাম বাড়েনি বরং কমেছে।

বিজ্ঞাপনে দাবি করা হচ্ছে বাবাদের নিরাপত্তা দিয়েছে মোদি সরকার! হ্যাঁ ঠিকই। কর্পোরেট বাবা অর্থাৎ আদানি আম্বানিরা তো এদের আমলে বিস্তর নিরাপত্তা পেয়েছে। ওদের জন্য করও মুকুব করা হয়েছে। অথচ গরিব মানুষকে এই মূল্যবৃদ্ধির থেকে বাঁচানোর জন্য দরকার ছিল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ না কমিয়ে দ্বিগুণ করা যাতে গ্রামের গরিব মানুষ তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে পারে। বাজেট বরাদ্দ থেকে বোঝা যায়,মোদি সরকার ১০০ দিনের কাজকে ১১ দিনে নামিয়ে এনেছে। দরকার ছিল চাষিদের ফসলের লাভজনক দাম সুনিশ্চিত করা। তাতো হচ্ছেনা উল্টে চাইতে গেলে চাষিদের ওপর বর্বর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। সরকারি বিজ্ঞাপনে ফসলের দেড়গুনা দাম দেওয়ার কথা বলে সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে। ফসল বীমার সুযোগ প্রকৃত চাষি কতজন পায় সেই তথ্য সামনে আনা হচ্ছে না। দরকার ছিল বিনামূল্যে চাল গম দেওয়ার সময়সীমা আরো বাড়ানো যাতে গরিব মানুষ খেয়ে পরে বাঁচতে পারে। শুধু ভোটের কথা ভেবে ফ্রি-তে চাল গম বিলোলে হবেনা। সব মিলিয়ে রেশন ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। শুধু স্বাস্থ্য-বীমা করে দিলে মানুষ বাঁচবে না বরং কোম্পানিগুলির লাভ হবে। দরকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় গরিব মানুষের জন্য সুলভে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত সুনিশ্চিত করা। এসব না করে ভোটের আগে বিজ্ঞাপনে খরচ বাড়িয়ে রং চড়িয়ে গরিব মানুষের দুর্দশাকে আড়াল করা যাবে না।

বিজ্ঞাপনে কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে যতই দাবি করা হোক,এদেশে মায়েরা এখন ভালো নেই। বেটি পড়ছে না, বাঁচার মতো বাঁচছেও না,সবটাই পরিহাসের কথা হয়ে গেছে। উন্নাও,হাথরস থেকে শুরু করে গুজরাটের উচ্চ আদালতে বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তার পরিবারের সদস্যদের খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া ও বীরের সংবর্ধনা পাওয়ার ঘটনায় এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায়।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে জরুরী অবস্থার সময়টুকু বাদ দিলে অতীতে কখনো বিরুদ্ধ মত এভাবে কণ্ঠরোধ করা হয়নি। স্বাধীন ভারতে কখনো এভাবে একসাথে ১৪৬ জন সাংসদ কে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়নি। মোদির সুরে সুর না মেলালেই কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে বিব্রত করার চেষ্টা চলছে। ব্রিটিশ আমলের দানবীয় রাষ্ট্রদোহ আইন ফ্যাসিস্ট কায়দায় নতুন কলেবরে লাগু করেছে মোদি সরকার। বিনা অপরাধে জেলবন্দি প্রতিবাদী ছাত্র -যুব- চিকিৎসক -আইনজীবী সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। সংবিধান-স্বীকৃত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বিপন্ন। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ও তার অনুসারীরা এখন এদেশে বীরের সম্মান পাচ্ছে। এর থেকে বড় লজ্জা দেশবাসীর আর কিছু থাকতে পারে না।

অতীতে কখনো এভাবে সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও তপশীলী সম্প্রদায়সহ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষের উপর ধর্ম-জাত পাত- বর্ণের অজুহাতে হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়নি। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে বিজেপি সরকারের বুলডোজার নীতি, আর্থিক দিক থেকে অসহায় পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্নকে ভেঙে গুড়িয়ে তছনছ করে দিয়েছে। সি এ এ – এনআরসির মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে বসবাস করা এ দেশের মানুষকে রাতারাতি বিদেশি বানিয়ে ফ্যাসিস্ট কায়দায় ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছে বর্তমান সরকার। বিভিন্ন সময়ে পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে আসা অসহায় মানুষ আজ আবার অসহায় এদেশে। নতুন করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্ক গ্রাস করেছে এদের মনের মধ্যে। বিশ্বজোড়া ক্ষুধার সূচকে আমরা ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি অথচ সরকারের কোন হেলদোল নেই। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করছে লক্ষ লক্ষ গরীব কৃষক। না খেতে পেয়ে মরছে অসহায় পরিযায়ী শ্রমিক। মোদি সরকার ব্যস্ত ঢাক ঢোল পিটিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকার সেন্ট্রাল ভিস্টা অর্থাৎ নতুন সংসদ ভবন বা ৮ হাজার কোটি টাকার রাম মন্দির ইত্যাদি উদ্বোধনের কাজে।

আগামীর লড়াইটা তাই জাতের নয়, ভাতের– গতরখাটা মানুষের দুবেলা দুমুঠো গরম ভাত পাতে জোগাড়ের। লড়াইটা ধর্মের নয় কর্মের– বেরোজগারীর যন্ত্রণায় জর্জরিত অসহায় যুবক যুবতীর কর্মসংস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। মন্দির মসজিদ বিরোধের রাজনীতি নয়, আওয়াজ উঠুক— চাই সরকারি খরচে আরো বেশি বেশি করে স্কুল কলেজ হাসপাতাল। এপিএল বিপিএল নিরপেক্ষে চাই সব গরিবের রেশন, ফসলের লাভজনক দাম, ১০০ দিনের জায়গায় ২০০ দিনের কাজ ও ন্যূনতম ৬০০ টাকা মজুরি। চাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত নব্বই ভাগ শ্রমজীবী মানুষের কাজের নিরাপত্তা ও ন্যূনতম ছাব্বিশ হাজার টাকা মজুরি। এক দেশ এক ভাষা এক ভোট নয়– চাই দুর্নীতিমুক্ত, দাঙ্গা মুক্ত, লুটমুক্ত উন্নত ভারত, যেখানে বৈচিত্রের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠা করাই হবে প্রধান লক্ষ্য। এসব নিশ্চিত হতে পারে যদি আগামী লোকসভা নির্বাচনে লুটেরা কর্পোরেট ও আগ্রাসী হিন্দুত্ব বাহিনীর প্রতিনিধি বিজেপি ও এ রাজ্যে তার শরিক তৃণমূল কংগ্রেসকে কে পরাস্ত করে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।