দীর্ঘ দিন বামপন্হী সমমনোভাবাপন্ন দলগুলির সাথে আদর্শগত মেলবন্ধনে ফ্রন্টে আছে। এমনকি UPA-Iএ কমন মিনিমাম প্রোগ্রামের ভিত্তিতে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছে। তৃণমূল NDA এবং UPA-IIর মন্ত্রীত্ব সহ অংশীদারিত্বে ছিল। রাজ্যে কখনও বিজিপি, আবার কখনও কংগ্রেসের সাথে জোট বেঁধে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ভিন্নধর্মী অবস্হানের সমালোচনা হতে পারে, তবু সর্বসমক্ষে প্রচারিত হয়েছিল। এমনকি SUCI, PDSও তৃণমূলের জোটে ছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক সুবিধার্থে সমধর্মী বা বিধর্মী দলের সাথে সহাবস্হান হতে পারে। ২০২৪র লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের অবস্হান, আঞ্চলিক দলগুলি নিজ ক্ষেত্রে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে, অর্থাৎ কংগ্রেসের সাথে ঐক্যের প্রাক-নির্বাচনী বন্ধুত্বের কোন ভাবনা নেই। নির্বাচনোত্তর পরিস্হিতিতে কিং-মেকার হতে পারলে যাবতীয় ঘৃণ্য দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমার উপর যবনিকা ফেলা সহজ হবে। সে বিজেপি হতে পারে বা কংগ্রেস কিংবা তৃতীয় ফ্রন্ট। চালাকিটাও স্পষ্ট অবস্হান। সময়ের সাথে রাজনৈতিক দলের অবস্হান বদল স্বাভাবিক ঘটনা।

সহাবস্হান ও সেটিং-এর অর্থ এবং প্রয়োগ ভিন্ন। সাধারণতঃ কোন অবৈধ কর্মে ক্ষমতাশালীর সাথে সুবিধা আদান প্রদানে সাময়িক সমঝোতাকে বলে সেটিং। মনে করুন, বিনা টিকিটের যাত্রী রেলের চেকারের সাথে ঘুষ দিয়ে সেটিং করে সফর করল। টিটির কর্তব্যের গাফিলতি অর্থের বিনিময়ে কিনে অপরাধী অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ভ্রমণ করল এবং সামগ্রিক ভাবে ক্ষতি হল রেল কোম্পানি বা বৃহত্তর অর্থে দেশের। সে রকম পুলিশের সাথে সেটিং করে অবৈধ বস্তুর পরিবহণ করছে দুষ্কৃতিরা। কোন এক নেতার মেয়ের নিটের তালিকায় স্হান ১,২১,৪৭৩তম, কিন্তু আর.জি.কর মেডিকাল কলেজে পড়ার সুবিধা পেল। আপনি ভাবতে পারেন, তাতে ক্ষতি কী হল? যোগ্য একজন প্রার্থী অন্ততঃ বঞ্চিত হল, যে মেধার ভিত্তিতে সমাজকে অপেক্ষাকৃত উন্নততর সেবা ফিরিয়ে দিতে পারত। আরো সহজে, মীরজাফর নবাব হবার জন্য রবার্ট ক্লাইভের সাথে সেটিং করেছিলেন। সেটিং বৃত্তে দুইয়ের আধিক্যে বলা হয় চক্র। যেমন মধুচক্র, মাফিয়াচক্র, হ্যাকিং চক্র ইত্যাদি। উভয় পক্ষের সাময়িক লাভে আখেরে ক্ষতি দেশের।

সেটিং শব্দটা বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য না হলেও খুব কাছাকাছি। আমাদের ছোটবেলায় যারা ইস্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশনি পড়ত, তারা সাধারণতঃ ভাল ফল করত। সেটিংটা শিক্ষকের ক্ষেত্রে অস্বস্তিদায়কের বদলে বিজ্ঞাপন হিসাবে কাজ করত। সেটাকে সেটিং বলা হত না। সেটিং শব্দটা অনেক পরে শুনেছি। বান্ধবীকে নিয়ে অমূক রেস্টুরেন্টের কেবিনে বসলে অমূক ওয়েটার পর্দা টেনে দিয়ে যেত। এই প্রচার রেস্টুরেন্ট এবং ওয়েটারের আর্থিক লাভ তরাণ্বিত করত। এমনকি খেলার মাঠে কিছু পুলিশ, সিনেমা হলের লাইটম্যান থেকে বাসের কোন কন্ডাক্টর সেটিংর উদাহরণ। উপরের তলায় সেটিং তখন বুঝতাম না। কালোবাজারী, ভেজাল মিশ্রণের মত অবৈধ কর্ম নেতা ও পুলিশের সাথে সেটিংএ পল্লবিত ছিল। একটা সময়ে বোঝা গেল, সেটিং আমাদের সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ক্লাবের সেক্রেটারির পদ থেকে কর্মক্ষেত্রে ভালো পোস্টিং। এমনকি একাধিক সন্তানের মধ্যে বিশেষ কোন সন্তানকে আধিক গরুত্বও নাকি সেটিংএর ফসল। নিম্নস্বরে বহুল প্রচলিত শব্দটা কিন্তু মানুষ নিজের ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলে।

২০১৪সাল থেকে মোদী-মমতার সেটিং উচ্চস্বরে বহুচর্চিত। কদাপি পদ্ম-ঘাস ফুলের মিলনের ব্যাপকতা পেলেও দিন শেষে মোদী-মমতার বৃত্তে শেষ হত। জনগন মমতা-শুভেন্দু বা অভিষেক-সুকান্তের সেটিং বার্তা দেয় না। নয় বছর ধরে লয়-ক্ষয় হীন একটা ধারণা ভিত্তিহীন অমূলক হতেই পারে না। যদি তাই হত, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা জনগনকে শুধরে নেবার বার্তা দিতেন। মোদী-মমতার সেটিংর লজ্জাকর তথ্য থেকে মমতা কখনও নাটুকে সরব হলেও লোকে ধরে নিয়েছে, সেটা সংখ্যালঘুদের ভোট হারাবার ভয়ে। তুলনায় নীরব মোদী। বিরোধীরা বারবার বলেছে, বাইরে কুস্তি, ভিতরে মস্তি। আজ নয় বছর পর কোন ডায়ালগে এই বদনাম বিচূর্ণ করা অসম্ভব। সক্রিয় পুরুষাকারে কর্মের দ্বারা ভ্রান্তি দূর করা যায়। কর্নাটক নির্বাচন হারার পর বৃদ্ধ মোদীর সে শক্তি নেই। ফলে মোদীর ইতিহাসে সেটিংর তকমা থাকবে। লালকৃষ্ণ আদবানি এথিক্স কমিটির একটা মিটিং বসাতে পারেননি। মোদীর নির্দেশের আলকাতরা মুখে মেখেই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে। সেটিংবাজের জীবনে পরিণতি শুভ হতে পারে না, এটা চির বাস্তব।

মমতা মোদীর চারিত্রিক দুর্বলতা কাজে লাগাবার চেষ্টা করবেন সেটা স্বাভাবিক। উনি আম, দই, কুর্তা, পাজামার সাথে ভেট পাঠাবেন। মোদী বলতে পারবেন না, “না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা।” এখানেই মমতা সফল। সেখানে রাজ্য বিজেপিও ব্যর্থ। এই বিষয়ে যে শুভেন্দু-সুকান্ত থেকে তথাগতরা ঠারেঠোরে বলেন না, তাও নয়। কথায় আছে, বিষাক্ত সাপের বেশী কাছে যাওয়া বিপজ্জনক। গুজরাত দাঙ্গার খালাস, বাবরি ভাঙ্গার বেকসুর, বিলকিস ধর্ষকদের মুক্তি, রামমন্দিরের ছাড়পত্র, নোটবন্দীর পাপ, রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ অপসারণ- এসব বেশ দ্রুত কার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু বাংলার চিটফান্ড, নারদ তদন্ত পথ হারায়। এই হারানো পথের সন্ধানে চোরদের অনেক দক্ষিণা দিল্লীর মসনদের আশেপাশে হারিয়েছে। বিগত নয় বছর চিটফান্ড বা সাত বছরে নারদ তদন্তে অগ্রগতি হয়নি। মোদী ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন? যে কাজটাই শুরু করেননি, সেখানে ব্যর্থ হবেন কী করে? কলকাতা হাইকোর্ট নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় পরিত্রাতার ভূমিকা পালন না করলে আরেকটা ব্যাপমের মত কিছু লাশে দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটে যেত।

নরেন মোদী যুগপুরুষ। মমতা সততার প্রতীক। কত ভক্ত খোল করতাল নিয়ে হনুমানের গান গায়। অমিত শাহ যেমন স্পষ্ট স্বীকার করেছেন, প্রত্যেক নাগরিককে ১৫ লাখের প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী জুমলা ছিল, সে রকম চিটফান্ডের মামলা বা নারদ তদন্ত লোক দেখানো রসিকতা মেনে নিন। তাতে মোদীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে। গরু, কয়লা পাচারে যে কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্হাগুলির সহায়তা লেগেছে, তাও সবাই জানে। যে সাহসী কিশোর বেলায় পুকুরে কুমীর পালন করতেন, তিনি বার্ধক্যে বীরভূমের বাঘ পুষবেন তাতে গল্পের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখবে। এনটায়ার পলিটিকাল সায়েন্সটা বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হবে। রাজনাথ সিং যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, তখন পাচার-পাঁচালি নদীতে ঢেউ উঠেছে। এই রাজুদাকে আমরা ধর্মতলার বার্গার-চকোলেটের অনশন মঞ্চে দেখেছিলাম। দেশবাসীর স্বার্থে কেঁদে ওঠা মহাপ্রাণ যে কাঞ্চণমূল্যে পরিশোধ নেবেন না, তাই হয়? আমরা ভাবছি, পাচার তদন্তে বোধকরি তৃণমূলে অস্বস্তি বাড়ে। মমতা জানেন, সুতোর একটা দিকে টান পড়লে মোদীখানায় ঘুমের অভাব হয়।

ভাইপো হুঙ্কার দেন, মোদী কিস্যু করতে পারবেন না। মোদীকে আনত শিরে শুনতে হয়। ভক্ত হতবাক। মমতা কখনও সেটিং তত্ত্ব প্রকাশ্যে আনবেন না। সংখ্যালঘু ভোট ধর্মীয় মেরুকরণের সোনালী ফসল। তিনি অকথ্য কথা বলেন, নীরব মোদী। মোদী-মমতার গোপন বৈঠক নিয়ে সমালোচনা হয়। আবার দেখা যায়, গোয়া, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে তৃণমূল হাজির থাকলে বিজেপির জয় সুগম হয়, কিন্তু হিমাচল বা কর্নাটকে তৃণমূল নেই, বিজেপি হেরে যায়। তারপরেও ছাগলরা দাবী করে মমতা নাকি কেবল মোদীকে হারাতে পারেন। মোদী বিরোধী ঐক্য ভাঙ্গতে সর্বাধিক যোগদান আছে মমতার। তাঁর সাথে মোদীর যে সেটিং থাকবে সেটাই স্বাভাবিক এবং সত্য। তাহলে বাংলায় এক কোম্পানির দুটি মাল শোকেসে রেখে কী করব? ঘাস ব্র্যান্ড যদি থাকে তাহলে পদ্মছাপের দরকার কী? হাত দিয়ে ধরে কাস্তে দিয়ে কাটলেই জঞ্জাল পরিষ্কার হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্য শুভেন্দু-সুকান্তদের। ওঁদের রাজা হবার বাসনা ছিল। আজ নয় কাল বুঝবেন, বানিয়ার ঘরে দীর্ঘ বাস বাঁশসম কন্টকময়। ভক্ত বানিয়া লাভদায়ক মূল্যে রাজধর্ম বেচে দেন।

নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত শত্রু কেবল চাকরি বিক্রীর ক্যাম্পের কর্মচারিরা নয়। ব্যতিক্রমী শিক্ষকের বৈপ্লবিক চিন্তাবিদ রাজ্য সরকারের ক্যাবিনেট, এবং দূর গ্রহের সেটিং প্রভূ। অনেকে প্রশ্ন করেন, দূর আকাশে বৃহস্পতি শনির কোন প্রভাব কি মানব-কর্মে পড়ে? হাত গরম প্রমাণ না থাকলেও দেখবেন সব কিছু কেমন যেন শ্লথ হয়ে যায়। তদন্তকারী সংস্হাগুলি আদালতে ভর্ৎসিত হলেও নড়ে না। দূরের কোন প্রভূ হয়ত বাংলার আম, দই, কাঁচাগোল্লা খাচ্ছেন ঢেঁকুর তুলে। এই তৃপ্তির নাম সেটিং। রাজ্যের ভক্তরা যদি ভাবেন, এই সেটিংএর ফাঁক দিয়ে ক্ষমতায় আসবেন, ভুল ভাবছেন। মোদী সেটিং করেন দিল্লীর দখল রাখতে আর মমতা বাংলার। আপনারা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি দেখে ভাবলেন, গদী উল্টে যাবে। ব্যর্থ মোদীকে বাংলা ভোট দেবে না, মোদীর কাজ অন্য কাউকে বিরোধিতা করতে না দেওয়া। ৮০০দিন যোগ্য আন্দোলনকারীরা পথে বসে আছেন। কোন শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রী থাকলে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াতেন। এই রাজনৈতিক খেলাটাও মোদী খেলতে পারছেন না। কারণ- মোদী-মমতার সেটিং।

দুই নেতিবাচক ব্যক্তির সমঝোতা সদা ধনাত্মক হয়। ক্ষতিকারক ব্যক্তিদের আন্তরিক লেনদেন উভয়ের অবিঘ্নিত ফায়দা সরবরাহ করতে থাকলে তা বহু বৎসর বলবৎ থাকে। সেটিং কিন্তু আবার বন্ধুত্ব নয়। বন্ধুত্বে লাভ ক্ষতির হিসাব থাকে না। বন্ধুত্ব বিজ্ঞাপনহীন উন্মুক্ত, সেটিং বিজ্ঞাপন দিয়ে গোপন রাখা হয়। কেউ কিন্তু বলেন না, মোদী-মমতার সুদৃঢ় বন্ধুত্ব আছে। তেমন প্রচারে উভয়ের ক্ষতি। মানে মোদী বা মমতাকে ক্ষতিকারক মনে করেন, এমন অন্ধ ব্যক্তি মোদী বা মমতার সমর্থকদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁদের খুশী রাখতে মুখোশ আবশ্যিক। জনগন দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এই সেটিং আবিষ্কার করে, লালন করে এবং ইতিহাসের মহাফেজখানায় পাঠিয়ে দেয়। যেদিন ওনাদের কেউ থাকবেন না, সেদিনও ইতিহাস বলবে মমতার অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতির সহায়ক ছিলেন মোদী বা মোদীর জনবিরোধী সব বিলের গোপন মদতদাতা ছিলেন মমতা। এনআরসি বিল রাজ্যসভায় পাশ করাতে পারতেন না মোদী। তখন মমতার সাংসদরা কৌশলে ভোটদানে বিরত থেকে রাজ্যসভা ত্যাগ করলে এনআরসি বিল পাশ হয়ে যায়।

আমরা শিশুদের বলি, চুরি করবে না, অসত্য বলবে না, কারো ক্ষতি করবে না। কিন্তু আমরা বলি না, সেটিং করবে না। সেটিং এতটাই ঘৃণ্য ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক যে শিশুরা তা করতে পারে, মানুষ ভাবতেই পারে না। সবার শৈশব বা প্রতিপালন সুখকর হয় না। শিক্ষার সুযোগ ও নৈতিকতার অভ্যাসে তারতম্য থাকে। মোদী বা মমতা জনশ্রুতি ভুল প্রমাণ করতে এক কদমও এগিয়ে আসেননি। মোদী কখনও বিবৃতি দিয়ে বলেননি, চিটফান্ড বা নারদ তদন্তে তিনি ব্যর্থ, সে ব্যর্থতা দূর করতে আগ্রাসী ভূমিকা নেবেন। বরঞ্চ যে বিচারকরা সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছেন, তাঁদের মানুষ শ্রদ্ধা করছে। মোদীর সেটিং ও ব্যর্থতার চালচিত্রে মানুষের স্বপ্নের দ্যূতি উজ্জ্বলতর হয়েছে। কোথাও ঘৃণা আছে, তাই ভক্তিও অন্য কোথাও বিরাজমান। মোদী-মমতার ঐতিহাসিক সেটিং ভারতের ইতিহাসে গোপন খুনী ষড়যন্ত্রকারীর মত এক কালা অধ্যায়। মানুষকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষিত হতে হবে, যাতে দেশের পরবর্তী নেতৃত্ব শিক্ষিত হন। সেটিং মুক্ত উদার অগ্রগামী দেশ গড়তে পারেন।