সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে নবনির্মিত সংসদ ভবনের মাথায় যে অশোক স্তম্ভটি বসানো হচ্ছে তার সিংহের হিংস্র চেহারা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক শুরু হয়েছে। সারনাথের যে অশোক স্তম্ভ আমাদের দেশের প্রতীক, তার সিংহের মুখ আদৌ এমন দেখতে নয়। তাই বিতর্ক ওঠাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি মনে করি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিল্পী কে দোষী  সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না। কারণ, শিল্পী হয়তো মোদী বা শাহর কার্যকলাপের কথা ভাবতে ভাবতে সিংহের মুখটা বানিয়েছেন। গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গা তথা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সময়  থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হওয়ার পর এই জুটি ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের যে হিংস্র চেহারা তথা কার্যকলাপ সারা দেশের মানুষ দেখে চলেছেন, শিল্পীর তৈরি সিংহের মুখ তার চাইতে কি খুব একটা আলাদা কিছু? আমার তো তা মনে হয় না। আমজনতার মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিতে এবং হিন্দুত্ব  ও হিন্দুরাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলতে যে বুলডোজার সংস্কৃতি চালু হয়েছে গোটা দেশজুড়ে, এই সিংহ সেই বিপন্ন গণতন্ত্রের প্রতীক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক  সার্বভৌম রাষ্ট্র ভারতবর্ষের প্রতীক নয়।

আচরণেই এটা স্পষ্ট, কেন্দ্র এবং রাজ্যের উভয় শাসকদলই চরম স্বৈরাচারী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। উভয় সরকারই গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন এজেন্সিকে কাজে লাগাতে এতোটুকু দ্বিধা বোধ করেনা। কেন্দ্রীয় সরকার, নতুন করে নিজেদের তৈরি করা ইউ এ পি এ-র মত কিছু দানবীয় আইন ছাড়াও সিবিআই, ইডি প্রমুখ এজেন্সিগুলোকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ইচ্ছে মত কাজে লাগায়। রাজ্য সরকারও পুলিশ, সিআইডি, সিট  প্রভৃতি সংস্থাগুলিকে একইভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এই সংস্থাগুলির স্বাধীনভাবে কাজ করবার পরিধি ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে, তাই জনমানষে এদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যেতে বসেছে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসকদলের ইচ্ছে মত খাপ থেকে হাতিয়ার বার করবার ঠেলায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মিথ্যা অভিযোগে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলে পচে মরতে হচ্ছে নিরপরাধ মানুষকে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতির সমালোচনা করে পথে নামলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ জেলে ঢোকানো হচ্ছে। মুসলিম হলে বিপদ আরও বেশি। চিকিৎসক, সমাজকর্মী, সাংবাদিক — কেউ রেহাই পাচ্ছেন না এদের হাত থেকে। মানবাধিকার কর্মী স্ট্যান স্বামী এভাবেই খুন হয়েছেন গরাদের অন্তরালে। ন্যায়বিচারের ন্যূনতম সুযোগ এরা কেউ পাচ্ছেন না।

পশ্চিমবঙ্গেও একই কায়দায় বহু বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা ও সমাজকর্মীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বছরের পর বছর হয়রানি করা হচ্ছে। এখানেও সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের বেফাঁস প্রশ্ন করলে বা প্রতিবেদন পেশ করলে আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়। একটা সামান্য কার্টুন সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করার অপরাধ যাদবপুরের জনপ্রিয় অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র কে কি পরিমান হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এবং  হচ্ছেও, তা আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি। বেসুরো কথা বললে, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরাও এই আক্রমণের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না। অসহায় ভাবে প্রাণ হারাতে হচ্ছে এদের অনেককেই। আবার রাজ্য সরকার চাইলে, পুলিশকে খুন করার অপরাধে অভিযুক্ত এবং পুলিশের খাতায় ফেরার বিমল গুরুং কেও পুলিশি প্রহরায় জামাই আদর করে নবান্নে ডাকা হয়। এই ব্যবস্থায় কেউ নিরাপদ নয়, পুলিশও না।

উমর খালিদ, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ও গবেষক। কী তার অপরাধ?  প্রথম অপরাধ সে মুসলমান। দ্বিতীয় অপরাধ, ছাত্র থাকাকালীন জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের নানা জরুরী দাবি নিয়ে সে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। তৃতীয় অপরাধ, সে দিল্লির সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, উমর কে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে গ্রেপ্তার  করে তিহার জেলের কুঠুরিতে রাখা হয়। দীর্ঘদিন পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবার সুযোগ টুকুও তার ছিল না। রাস্ট্র এইসব স্বাধীনচেতা নাগরিকদের ঠিক কী পরিমাণ ভয় পায় একটি তথ্য থেকেই পরিষ্কার হয়। দিল্লি পুলিশ উমরের বিরুদ্ধে মোট সতেরো হাজার পাতার চার্জশিট জমা দিয়েছে। চার্জশিটের আয়তন এত বেশি যে, তার আইনজীবী বারংবার চেয়েও জানতে পারেননি ওমরের বিরুদ্ধে অভিযোগ টা সঠিক কি কি। মত প্রকাশের অধিকার তো এ দেশের সংবিধান স্বীকৃত। তাহলে কেন শুধুমাত্র সেই অপরাধে উমরের মত নিরপরাধ কৃতি ছাত্রকে রাষ্ট্রদ্রোহী সেজে জেলের অন্ধকারে দু বছরের বেশি সময় কাটাতে হবে ? কেন তার মাকে অসহায় ভাবে মাথা খুঁড়ে মরতে হবে ছেলের ন্যায় বিচারের আশায় ? নোয়াম চমস্কি, রাজমোহন গান্ধী সহ বহু বুদ্ধিজীবী সমাজকর্মী উমর খালিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে একাধিকবার সরব হয়েছেন। সরকারি তরফে কোন ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। দুনিয়ার মানুষ একথা জেনে গেছে, এদেশে আজ মানবাধিকার বিপন্ন। শুধু জম্মু কাশ্মীর নয়, দেশের কোথাও গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত নয়।


অনিস খান পশ্চিমবঙ্গের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র। কি তার অপরাধ ? প্রথম অপরাধ, সে মুসলমান। দ্বিতীয় অপরাধ,  সেও উমরের মত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র  আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং একই সাথে সিএএ -এনআরসি বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হাওড়া জেলার আমতার এক প্রত্যন্ত গ্রামে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছে আনিস। গ্রামের সবার কাছে অতি প্রিয় কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। বিপদে-আপদে ডাক দিলেই সাড়া পাওয়া যেত তার। গ্রামে রক্তদান শিবির আয়োজন করতে গিয়ে শাসকদলের বাধার মুখে পড়ল সে। হুমকিও এল বিস্তর। কিন্তু কখনও সে ভাবতে  পারিনি তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অপরাধে এভাবে অসহায় অবস্থায় প্রাণ দিতে হবে। আনিস নিছক দুর্ঘটনার শিকার হয়নি, তাকে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে মাঝরাতে খুন করা হয়েছে– এ কথা বারংবার তার বাবা সালেম খান সহ পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই বলছেন। শুধু সংবাদ মাধ্যমে জানা গেল, সিট তার রিপোর্টে বলেছে আনিস ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে। ওর বিরুদ্ধে নাকি আরো অনেক অভিযোগ আছে! বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। তাই, এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু প্রশ্ন তো করাই যায়, আনিসের বাবা, ভাই, বোন সহ তার আন্দোলনের লাখো সহযোদ্ধা তার খুনের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, এমনকি আন্দোলন করতে গিয়ে বিনা অপরাধে জেলও খেটেছেন, সেই দাবি কি অসঙ্গত কিছু? আনিসের বাবা কি তার ছেলের খুনের ন্যায়বিচার পাবেন না ? এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ সহ শাসকদলের নেতাকর্মীদের শাস্তি দেখে যেতে পারবেন না? তারা বহাল তবিয়তে অন্যত্র ট্রান্সফার নিয়ে আরও পাাঁচটা আনিস কান্ড ঘটানোর প্রস্তুতি নেবে?

 আমরা কি এভাবেই মুখ বুজে সইবো সব নাকি উমর খালিদের নিঃশর্ত মুক্তি এবং আনিস খানের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পথে নামবো, আরও বৃহত্তর লড়াই আন্দোলনে শামিল হওয়ার তাগিদে ? সময়ের হাতে বেশি নেই। দেশ বাঁচাতে এবং দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ রক্ষা করতে পথে নেমে এই আন্দোলনের নতুন পথ খোঁজা এখন সবচাইতে জরুরি কাজ।