পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের একের পর এক কেলেঙ্কারি দুর্নীতি সংবাদ শিরোনামে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে,রাজ‍্যের সরকারি প্রশাসনকে এই দুর্নীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে ব‍্যবহার করা হচ্ছে। এমনটা অবশ্যই প্রত‍্যাশিত নয়। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নানাবিধ দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা তাঁদের পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে সততার সঙ্গে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অতি সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে তদন্তকারী সংস্থার হাতে আটক হয়েছেন শিক্ষাবিভাগের দুই পদস্থ কর্তা যাঁরা কোন এক সময়ে শিক্ষক ছিলেন। শুধু তাই নয় কয়লা পাচার কাণ্ডে একযোগে আটজন আইপিএস আধিকারিক কে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছে ইডি। কোন না কোন সময় দুর্বল মূহুর্তে এঁরা দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্যই রাজনীতিবিদদের অসততা নিয়ে , বেআইনি রোজগার নিয়ে -যত মুখরোচক গল্প আছে ঘুষখোর সরকারি কর্মীদের নিয়ে গল্পের সংখ‍্যা তুলনায় কম। তবুও উৎকোচ প্রিয় দারোগাবাবুরা মাইনের টাকা ব‍্যাঙ্কে জমিয়ে রাখেন এমন জনশ্রুতি নিতান্তই দুর্লভ নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মচারীরা ব‍্যাপক অংশে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন এমন ঘটনা তেমন শোনা যেত না। পরিবর্তনের পরে গত এক দশক ধরে ধীরে ধীরে ছবিটা পাল্টালো। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির সঙ্গে সরকারি আধিকারিকদের একটি অংশের যোগসাজশ যত স্পষ্ট হচ্ছে প্রশাসন যন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ততই কমছে। রাজনৈতিক আনুগত্য এক্ষেত্রে যত বড়ো ভূমিকা নিয়েছে রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্বদের দেখানো লোভ তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে। তার সঙ্গে অবশ্যই বড়ো ভূমিকা নিয়েছে ভয়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদে না জড়ানোর ভয়।
সাম্প্রতিক উদাহরণই দেখা যাক, নিছক শাসকদলের এক জেলা সভাপতি গরুপাচার কাণ্ডে সিবিআই এর জেরা এড়াবেন বলে ডাক্তারি সার্টিফিকেট চাই,কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতাল ভর্তি নেওয়ার দরকার নেই বলে ফিরিয়ে দিয়েছে,তাতে কি নিজের জেলায় সভাপতি ফিরে আসবার পর তাঁর অঙ্গুলিহেলনে স্বয়ং জেলা শাসক ফোন করলেন জেলার সরকারি হাসপাতালের সুপারকে ডাক্তার পৌঁছে গেল ভিআইপির দরজায়। শাদা কাগজে প্রেসক্রিপশনে বিশ্রামের নিদান পাওয়া গেল। চাপে পড়ে রোগী দেখতে চাওয়া ডাক্তারবাবু বিবেকের তাড়নায় মিডিয়ার সামনে স্বীকার করেছেন তিনি চাপের কাছে নতিস্বীকার করে এমন কাজ করেছেন। সেই কারণেই পরের দিন ঐ ভিআইপিকে সিবিআই হেফাজতে নিয়েছে। কিন্তু কি আশ্চর্য ঐ জেলাশাসক এবং হাসপাতালের সুপার দুজনের মূখেই কুলুপ।

টেলিভিশন চ‍্যানেলে এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তা রহস‍্য ফাঁস করেছেন। তিনি গরুপাচার চক্রের তদন্তের কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের এক জেলা সভাপতি সিবিআই হেফাজতে যাওয়ার পর টেলিভিশনে টক শো তে এসে বলেছেন, এখন পুলিশ ও সির বদলি নির্ভর করে শাসকদলের নেতা নেত্রীদের মর্জির ওপরে। পুলিশ থেকে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের একটি অংশ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন তাঁরা যদি শাসকদলের বড়ো নেতা মন্ত্রীদের অন‍্যায় অনুরোধ মেনে নেন তাহলে পছন্দসই পোস্টিং এবং সমসাময়িকদের টপকে প্রমোশন দুটোই সম্ভব। ফলে নৈতিকতার সঙ্গে আপস করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। মানুষের কাছে সরকারি প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ পরিবারের মরণাপন্ন রোগীরা কলকাতার সবচেয়ে আধুনিক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে দিনের পর দিন ঘুরেও শয‍্যা পান না অথচ তাঁদের হতাশ ক্ষুব্ধ পরিজনদের চোখের সামনে দিয়ে গ্রেফতারি বা জিজ্ঞাসাবাদ এড়াতে সেই হাসপাতালের বিশেষ ওয়ার্ডে শয‍্যা পেয়ে যান তখন বিশ্বাসযোগ্যতা ধাক্কা খায়। মহামান‍্য কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিরা ইদানিং অন্তত সরকারি হাসপাতালগুলির ওয়ার্ড রাজনৈতিক ভিআইপি দের “বাঙ্কার” করার ব‍্যাপারে সতর্ক হয়েছেন – এটুকুই আশার কথা। কিন্তু রবীন্দ্রসদন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ভারতবিখ‍্যাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়ে দালাচক্রের বাইরে একটা ফিসফিসানি কানে আসে, “কোন পলিটিক‍্যাল সোর্স আছে দাদা? এখানে এমনি এমনি পেশেন্ট ভর্তি হয়না।

নৈতিকতার সঙ্গে এই আপস এখনো মানুষ সহ‍্য করছে নিতান্তই শাসকদলের ও পুলিশের যোগসাজশে ধমক চমকের ভয়ে। ভয় কাটলে কি হয় রাস্তায় নেমে পার্থ চ‍্যাটার্জী ও অনুব্রত মণ্ডল বুঝতে পেরেছেন।