
পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতিতে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধি প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান কিন্তু সিবিআই বা ইডির তদন্তকারীরা ডাকলে অসুস্থ হয়ে পড়েন,সেই রাজ্যে ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবিতে পথ অবরোধ দেখলে বিস্মিত হওয়ার কোন কারণ নেই। গত ২২ শে জুন তৃণমূল ছাত্রপরিষদ নৈহাটির ঋষি বঙ্কিম চন্দ্র কলেজের অধ্যাপিকাকে পাঁচ ঘন্টা ঘেরাও করে রাখে প্রথম বর্ষে ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবিতে এবং বেআইনি কাজ না করার ব্যাপারে অনমনীয় অধ্যাপিকা চন্দনা ভট্টাচার্যকে ঘেরাওয়ের ফলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি হতে হয়। এই ঘটনার তাৎপর্য পশ্চিমবঙ্গের সংবেদনশীল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যাঁরা এমনকি নিজেদের রাজনীতি নিরপেক্ষ বলে দাবি করেন তাঁরাও উপলব্ধি করে প্রতিবাদে সামিল না হলে আগামীদিন আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
পরিবর্তিত পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল শিক্ষিত সচেতন মানুষের বৃহত্তম অংশের অন্যায় ও দুর্নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে অনীহা। গত এক দশকের কিছু বেশি সময় ধরে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের যাবতীয় সন্ত্রাস,দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেবল বামপন্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়া কোন ব্যাপক জনজাগরণ দেখা যায়নি এই বাস্তবতা অস্বীকার করবে কে? যে প্রতারিত চাকরিপ্রার্থীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও টাকার বিনিময়ে শাসকদলের নেতা মন্ত্রীরা তাঁদের চাকরি বিক্রি করে দিয়েছেন বলে শিক্ষকপদে যোগ দিতে পারছেন না বলে নিয়মিত বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন এবং নিয়মিতই পুলিশি নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন তাঁদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়ে সমাজে যেটুকু আলোড়ন তুলছেন তাঁরা কেবল বামপন্থী কর্মী সমর্থক। অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা শিক্ষক পদের চাকরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যোগ্য প্রার্থীদের পাশে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দায়েই স্বল্প সময়ের জন্য এসে বসছেন বা দাঁড়াচ্ছেন তার বাইরে কিছু নয়। এই কারণটা পরিস্কার করে দিয়েছে বূর্জোয়া গণমাধ্যম, “বেকার যুবক যুবতীদের ভোটে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা নেই বলেই এদের নিগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েও পার পেয়ে যায় শাসকদল। ” একই কথা আমরা পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ অধীর চৌধুরীর মুখেও শুনেছি।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত শিশুকিশোরদের পাঠ্য একটি ছোটগল্পে স্মরণীয় লাইন, “ভয়ের মধ্যে ভূতের বাস”! এখন ছোট ছোট আর্থিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নিজেদের “রাজনীতির সাতে পাঁচে না থাকা ” বলে পরিচয় দেওয়া একদল শিক্ষিত সহনাগরিককে পাড়ায় পাড়ায় শাসকদলের আশেপাশে ঘোরার অজুহাত হিসাবে বলতে শোনা যাচ্ছে “পাড়ায় থাকতে গেলে এখন ওটুকু করতে হচ্ছে ভাই কি করব?” দেখা যাচ্ছে খাদ্য সুরক্ষা যোজনার সামগ্রী রেশন দোকান থেকে সংগ্রহ করার লক্ষ্যে অথবা বাড়ির মহিলাদের নাম লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের তালিকায় তুলতে পাড়ার তৃণমূলী মাতব্বরদের সঙ্গে এই সখ্য গড়ে উঠেছে । ফলে বাড়ি তৈরির জন্য একটা ইঁট গাঁথার আগে তৃণমূলী কাউন্সিলরের সহচর তাঁদের প্রতিবেশীর কাছে দু লক্ষ টাকার তোলা চাইলে তাঁরা নীরব থাকেন।
অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। ক্যান্সারের চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে না পেরে লক ডাউনে ব্যবসা হারানো যে যুবক তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে আত্মহত্যা করলেন তিনিও সুখীগৃহকোণের স্বপ্ন দেখতেন, যে তরুণ বহুজাতিক কোম্পানিতে ঢুকে কাজের চাপ আর বেতনের সামঞ্জস্য খুঁজে না পেয়ে সাত বছরের মাথায় চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন তাঁর স্ত্রীকেও চাকরি খুঁজতে বেরোতে হচ্ছে। অর্থাৎ নির্লিপ্ততা এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারছে না। যাঁরা অগ্নিপথ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ দেখানো তরুণদের আচরণে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরাও বুঝতে পারছেন সারা দেশের মানুষের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার দায় সরকার ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড নিয়ে গেলে বেড না থাকা বা আমরা তালিকাভুক্ত নই শোনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রেশনে গম না পেয়ে গ্রামের রেশন দোকানের মালিককে জলের এ টি এমের ঘরে তালাবন্ধ করে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে ধিকি ধিকি আগুনের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে। এখন কেবল ভয় কাটানোর অপেক্ষা।