সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল র সেই বিখ্যাত উক্তি এখন বাস্তবে সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিবিআই ধরেছিল অনুব্রত কে। ভোট পরবর্তী হিংসা, গরু পাচার, কয়লা চুরি ইত্যাদি ইত্যাদি  হাজারো অভিযোগে। কদিন ধরে বেশ চলছিল টম এন্ড জেরি খেলা। পিজি হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ড তো এখন সিবিআইয়ের জালে পড়া আসামিদের স্থায়ী আশ্রয়স্থল। অনুব্রতর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে একাধিকবার। সিবিআই ডাক পাঠালেই  ডাক্তার নার্স ওয়ার্ড বয় সহ উডবার্ন ওয়ার্ড সেজে উঠতো কেষ্ট বরণ করবে বলে। ঠিক যেমনটা হয় মদনের সময়। দুদিন পি জি হাসপাতাল হয়ে সোজা চিনার পার্কের ফ্ল্যাট। কাট্, এই পর্যন্তই। দুর্নীতর এই রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ বেশ জমে উঠেছিল ক’দিন! খেলা চলতে চলতেই ঘটা করে একদিন পাত্র মিত্র সভাসদ সহ সিবিআই দপ্তরে হাজির হলেন অনুব্রত।  টানা জেরা চললো বেশ কয়েক ঘন্টা। তারপরই হঠাৎই দেখি সিবিআইয়ের ফোকাস থেকে অনুব্রত আউট, সেহগাল হোসেন ইন।

 নতুন এই চরিত্রটি রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল ও অনুব্রতর দেহরক্ষী l খুবই করিৎকর্মা লোক l কনস্টেবল তো কোন ছার, রাজ্য পুলিশের তাবড় হর্তাকর্তারাও এখন ওকে দেখে হিংসে করে l কনস্টেবল হো তো এ্যায়সা! জলি এল এল বি সিনেমায় এমনই এক কনস্টেবল দেখেছিলাম বটে, যাকে ডি সি আই সি রা সেলাম ঠুকতো, কারণ ওদের সবার পোস্টিং মোটা টাকার বিনিময়ে ওই ঠিক করতো। এও তেমনই এক ক্ষমতাবান কনস্টেবল! তাই বলছিলাম, ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়াল!! ছিল অনুব্রত, এসে গেল সেহগাল।

অডিটিং-এর একটা সহজ পাঠ হল, বাটপাড়ের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গেলে কোন আইটেমটা ভালো আর কোন আইটেমটা খারাপ তা চেনা অনেক সময় অডিটারের কাছে মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়,  কারণ আলুভাজা থেকে চাটনি সবটাই এক গোত্রের হয়ে যায়। সংগঠনের ‘ক’ থেকে ‘চন্দ্রবিন্দু’ সবাই চোর জোচ্চর হলে যা হয় আর কি।  ঠিক একইভাবে, একটা সরকারি সিস্টেমে যখন কনস্টেবল থেকে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী– সবার নামে নানা অভিযোগ জমা হতে শুরু করে,  কে ভালো আর কে মন্দ, সাধারণ মানুষের পক্ষে চেনা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। চারদিকে দুর্নীতির দুর্গন্ধ ‘গরমেন্ট- এর রুম ফ্রেশনার’ হয়ে ওঠে। শাসক স্বৈরাচারী হলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পায়। ঠিক যেমনটা ঘটছে আমাদের রাজ্যে এখন। কনস্টেবল সেহগাল হোসেন অনুব্রতর দেহরক্ষী হওয়ার পর, ছ’-সাত বছরের মধ্যেই একশো কোটিরও বেশি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়ে গেছে। ফ্ল্যাট, সোনা দানা, জমি, নগদ ও ব্যাংকে জমানো টাকl ইত্যাদি– সবমিলিয়ে যেটুকু হাতেনাতে পাওয়া গেছে তার হিসেব বললাম। আদালতকেও সিবিআই এই হিসাব জমা দিয়েছে। এখনো হদিস পাওয়া যায়নি এমন সম্পত্তির পরিমাণ কত তা ‘অন্তর্যামি কেষ্ট’ ছাড়া কেউ জানে না। এই কেষ্ট আবার পুলিশ কে বোম মারার বিধান দিয়ে পুরোদস্তুর পুলিশি পাহারাতেই ঘুরে বেড়ান। প্রয়োজনে ডি এম, এস পি দেরও সর্বসমক্ষে ধমকান। বিস্তর ক্ষমতা ওর। আর হবে নাই বা কেন? স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাত ওনার মাথায়। 

এমনটাও শোনা গেছে, এই কনস্টেবল টি গ্রেফতার হওয়ার পর বেশকিছু পুলিশ অফিসার গা ঢাকা দিয়েছেন কারণ, সেহগাল নাকি তাদের নামেও প্রচুর সম্পত্তি কিনে রেখেছে।  এখন প্রশ্ন হল, সেহগাল তো অন্যের নামে জমি বাড়ি ইত্যাদি কিনছে, আসল পান্ডাটি কে যিনি এই সবটা সেহগালের নামে কিনেছেন বা সেহগাল কে দিয়ে এসব করিয়েছেন? সেই ব্যক্তি কে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি কেন বা কবে গ্রেফতার করা হবে? হিসাব বহির্ভূত এই বিপুল পরিমান অর্থের উৎস কি? এর জন্য আম জনগণকে কতটা মূল্য চোকাতে হচ্ছে বা হবে? বগটুই কান্ডে ভাদু শেখের খুন‌ এবং তাকে কেন্দ্র করে এতগুলো নিরপরাধ মানুষের জ্যান্ত পুড়ে মরার ঘটনা না ঘটলে আমরা জানতেই পারতাম না তৃণমূল শাসনে দুর্নীতি তোলাবাজি ঠিক কোন মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আনারুল গ্রেফতার হল একথা ঠিক, নতুবা ওর গায়ে আঁচড় কাটার সাহসও পুলিশের ছিলনা। আনারুলের মাথারা কিন্তু দিব্যি জামাই আদরে পুলিশী পাহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু তাই নয়, নতুন নতুন অপকর্ম করে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? রাজ্যজুড়ে যে আনারুল বাহিনী মমতা দেবী কন্ট্রোল করেন, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছেনা কেন? কবে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেবেন সেই আশায় থাকতে গেলে তো আরো কিছু নিরীহ মানুষ এদের স্বার্থের সংঘাতে প্রাণ হারাবেন। এসবের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মাস পেরিয়ে বছর হবে, লক্ষী সরস্বতীর ভাঁড়ার নিয়ে এই সরকার তার মেয়াদপূর্তির দিকে এগিয়ে যাবে। আমরাও টম অ্যান্ড জেরির খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বো। ততদিনে মানুষ এসব কিছু ভুলতেও শুরু করবে। আবার নতুন খেলা শুরু হবে। 

সেদিন সেক্টর ফাইভ এর আইটি সেক্টরের এক পদস্থ অফিসারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথার ফাঁকে হঠাৎই বলে বসলেন, দূর মশাই এত লেখাপড়া করে এখন আপশোশ হচ্ছে। তার চাইতে মেট্রিক পাস করে অনুব্রতর দেহরক্ষী হতে পারলে সাত পুরুষের ধন কামিয়ে নেওয়া যেত । আমরা কি সত্যিই এভাবে রাজ্যটাকে দুর্নীতিবাজ তোলাবাজদের আখড়া হতে দেবো নাকি ‘না এ জিনিস হতে দেবোনা’ বলার স্পর্ধায় প্রতিরোধের পাঁচিল গড়ে তুলবো?

দুর্নীতির তদন্তের নামে  সিবিআই,  ইডি প্রমুখ কেন্দ্রীয় এজেন্সি বা রাজ্যের গোয়েন্দা দপ্তর বা সিট  যা করে, তা আজ আর সাধারণ মানুষ খুব একটা ভরসা করেন না। কারণ, এই কেন্দ্রীয় বা  রাজ্য এজেন্সিগুলিকে বিজেপি বা তৃণমূল দল‌ যে তাদের নিজেদের স্বার্থে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে চাপে রাখার জন্য ব্যবহার করে, তা আজ  দিনের আলোর মত পরিষ্কার। শাসকদলের সৌজন্যে এদের নিরপেক্ষ তদন্তের জায়গা এখন অনেকটাই সীমিত। নানা তদন্তে সিবিআই-র গড়িমসি নিয়ে আদালত অনেক সময় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির মামলায় অতিসম্প্রতি মাননীয় বিচারপতি একইভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সারদা নারদার পাহাড়প্রমাণ  দুর্নীতির তদন্ত আদালতের নির্দেশে শুরু হলেও কবে শেষ হবে  তা কেউ জানে না। এই তদন্তগুলি যত মেগাসিরিয়ালের রূপ পায়, অপরাধীরা বহাল তবিয়তে নতুন নতুন অপরাধ করবার পরিকল্পনা করবার সাহস পায়। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির মামলায় আদালত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে অপসারণ করেছে। একই অপরাধে কেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য,  মন্ত্রী পরেশ অধিকারী, বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রীদের  স্ব স্ব পদ  থেকে অপসারণ করা হবে না? এ রাজ্যের শিক্ষিত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের এভাবে লাঞ্ছিত করে  ভবিষ্যৎ নষ্ট  করে দেওয়ার অপরাধে কেন এদের গ্রেপ্তার করা হবে না?  বিধানসভায় দুর্নীতি নিয়ে এক বিতর্কের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী দলনেতা কে বলছেন, ‘দাদামনি আপনি কত জনকে চাকরি দিয়েছেন সে কথা বলবো?’ বিরোধী দলনেতা তো এই সেদিনও ছিলেন তৃণমূলের নেতা। তাই আলাদা করে না বলে দুজনে একসাথেই বলুন না, মোট কত ছেলে-মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন আপনারা? তাহলে, শুধু ওই বঞ্চিত মেধাবী  যুবসমাজ নয়, এ রাজ্যের আপামর জনসাধারণ বুঝে নেবে ঠিক কী শাস্তি হওয়া উচিত আপনাদের।  আজ না হোক কাল, জনতার আদালতে শাস্তি আপনাদের পেতেই হবে।