“দূর মশাই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভায় একটা আসন নেই লোকসভাতে একটাও এম পি নেই কথা বলেন কোন মুখে?” এই রাজ‍্যের শাসকদলের কেষ্ট বিষ্টুরা টিভি ক‍্যামেরার সামনে বামপন্থী প্রতিনিধিদের এমন প্রশ্ন করলে নাছোড়বান্দা জবাব তৈরি থাকে,” হেরেও মাথা উঁচু করে হাঁটি মশাই, দুর্নীতির দায়ে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়না, এলাকার মানুষও আড়ালে বলে না ভোট লুট করে পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ভোটে জিতেছি! বরং এখন তাঁরা আপসোস করেন বামপন্থীরা জিতলেই ভালো হত!” এমন পরিস্থিতিতে পাল্টা প্রশ্ন সঞ্চালকরাই কখনো কখনো করেন,তার মানে বলতে চাইছেন জনগণ না চাইলেও তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ‍্যে জিতছে? উত্তর দিই, “এত দুর্নীতি আর মানুষকে প্রতারণা করার পরেও মানুষের সমর্থন পেতে তো গা জোয়ারি করতেই হবে! খোদ মুখ‍্যমন্ত্রী বিরোধীশূন‍্য আইনসভা পেলে উন্নয়নের সুবিধা হয় যখন বলেন তখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বা বিরোধীদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব দু টোই সরকারের উদ‍্যোগে বিপন্ন হয়ে পড়ে। নিজের চোখে দেখা পৌর নির্বাচনে শাসকদলের প্রার্থী পোলিং বুথে যখন প্রিসাইডিং অফিসার সহ ভোটকর্মীদের দেখিয়ে যখন বলছেন,এঁরা সবাই আমার লোক বুঝেছেন তো! তখন সরকারি কর্মীদের থেকে কোন প্রতিবাদ হয়নি। দুয়ে দুয়ে চার ফল পেতে অসুবিধা হয়না যখন দেখতে পাই অধিকাংশ বুথে সিসি টিভি কোন কাজ করছে না। ফলে কোমরে জামার নীচে আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে বুথে ঢুকে জাল ভোট দেওয়া যেমন কোন সমস‍্যা হয়না তেমনি বাম প্রার্থীর কাউন্টিং এজেন্টদের মোবাইল ফোন গণনাকেন্দ্রের গেটে আটকে দেওয়া হলেও বিনাবাধায় গণনাকেন্দ্রের ভেতরে মোবাইল নিয়ে শাসকদলের কাউন্টিং এজেন্টরা ঢুকে পড়তে পারেন এই অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এমন জোর যার মুলুক তার – নীতি প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের প্রশ্রয় পেলে আগামীদিন শান্তিপূর্ণ রক্তপাতহীন নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। রকম সকম দেখে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার অনীহা বাড়ে।

আসলে পঞ্চায়েত স্তর থেকে লোকসভা অবধি “আমাদের সব আসন চাই”- শ্লোগান বুথ স্তর অবধি ছড়িয়ে দেওয়া হয়।যেখানে বিরোধীদের সংগঠন তুলনামূলকভাবে জোরদার সেখানে শাসকদলকে পিছু হটতে হয় নয়ত তৃণমূল কংগ্রেস নয়ত বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কংগ্রেস অথবা বিজেপি এই তিন তাসেই ভোটের খেলা চলে! ফলে টেলিভিশন চ‍্যানেলে বা সংবাদপত্রে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতানেত্রীদের শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার প্রতিশ্রুতির সিকি পয়সা দাম থাকে না। কারণ ব‍্যক্তিগত আলাপচারিতায় বর্তমান লেখকের কাছে ব‍্যাখ‍্যা করেছেন তৃণমূল সমর্থক হিসাবে পরিচিত এক অধ‍্যাপক। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, নির্বাচনে জয়ের জন‍্য কেবল রাজনৈতিক সাফল‍্য নয় অর্থনৈতিক লাভের লক্ষ্যেও মরীয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাসকদলের নেতা কর্মীরা। শাসক দলের অঘোষিত নীতি অনুযায়ী পঞ্চায়েত নির্বাচন বা পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্তত পঞ্চাশ লক্ষ টাকা রোজগার করার সুযোগ তৈরি করতে পারেন। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। লোকসভা বা বিধানসভায় সমর্থন ভাগাভাগির অনেকটা কাজ মিডিয়া করে দেয় বলে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়ে যায়। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামপন্থীরা অধিকাংশ জায়গাতে সন্ত্রাসের কারণে প্রার্থী দিতে না পারলেও তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে তুলে আনার লক্ষ্য পূরণ করার জন‍্য বিজেপিকে মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগেই বিজেপি কে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বাংলার মিডিয়ায় দ্বিতীয় শক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস কে রুখতে পারে একমাত্র বিজেপি – একথা টেলিভিশন চ‍্যানেল খবরের কাগজে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং জনগণের মধ‍্যে স্থানীয় স্তরে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আবার এলে পশ্চিমবঙ্গে চিটফাণ্ড সহ নারদা চ‍্যানেলের স্টিং অপারেশনে ধরা পড়া দুর্নীতিগ্রস্তদের যাবতীয় কেলেঙ্কারির তদন্ত করে সাজা দেওয়া হবে এই প্রচার চালানো হয় যার ফল বামপন্থীদের ভোটে বিরাট ধস। তখন থেকেই বামপন্থীদের তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী প্রচারে বিজেপির সুবিধা হয়েছে আবার বিজেপি বিরোধী প্রচারে তৃণমূল কংগ্রেসের সুবিধা হয়েছে। এই ঢেউ ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন অবধি প্রবলভাবে ছিল। পরবর্তীকালে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে যাওয়া অনেক এম এল এ এম পি তৃণমূল কংগ্রেসে আবার ফিরে আসার পর জনগণের বিভ্রান্তি কিছুটা কাটে এবং কতকটা সেই কারণেই প্রধান শত্রু বামপন্থীদের বিশেষত সিপিআই(এম) কে রুখে দিতে একইসঙ্গে পুলিশ – প্রশাসন ও রাজ‍্য নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগাতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সদ‍্য সমাপ্ত পৌরসভার উপনির্বাচনেও এর ব‍্যাতিক্রম ঘটেনি। চন্দননগর পৌরসভায় যে আসনে জয়ী হয়েছেন বামপন্থীরা সেখানে বুথ স্তরের সমস্ত কর্মী কমবেশি সারাবছর সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বলে শাসকদল যেমন সুবিধা করতে পারেনি তেমনি বিজেপির জামানত জব্দ হয়েছে। সারাবছর বামপন্থীদের অধিকাংশ কর্মী বুথস্তর থেকে সক্রিয় আছেন মানে ভোটের দিন পোলিং স্টেশনের ভেতরে বাইরে এবং গণনাকেন্দ্রেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়া কর্মীর অভাব হয়না।

হাওয়া বদলের পূর্বাভাস পেতে আমরা এভাবেই নজর দিয়েছি একেবারে তৃণমূল স্তরে। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতারণা ব‍্যাপক দুর্নীতি এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পাশাপাশি বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির কারণে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য,সীমাহীন বেকারত্ব এবং দ্রব‍্যমূল‍্যবৃদ্ধির রাশ না টানতে পেরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিয়ে আড়াল করার কৌশলের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচারে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করার কোন শর্টকাট বিকল্প নেই। সবচেয়ে বড় কথা বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক বোঝাপড়া যেভাবে প্রতিদিন উন্মোচিত হচ্ছে তার পূর্ণ সুযোগ নিতে হবে। নির্বাচকরা বামপন্থীদের কাছ থেকে প্রতিরোধ ও নিরাপত্তার আশ্বাস পেলে শাসকদের জবাব দিতে তাঁরা দ্বিধা করবেন না।