
উনিশশো চৌষট্টি সাল। ব্রাজিলে সামরিক অভ্যুত্থান রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটাল এবং অবশ্যই পাল্টে দিল সেখানকার জনসাধারণের জীবন ও মানসিকতা। মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা পেশায় সরকারি রাজস্ব আধিকারিক তাঁর বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে রাইমুণ্ডো ভিয়েরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন দেখে তাঁর বছর দশেক বয়সী বড়োছেলে সক্রেটিস ব্রাসিলিরিও সাম্পাইও ডি সুজা ভিয়েরা ডি অলিভিয়েরা বিস্মিত হয়ে ভেবেছিল কি এমন ঘটনা ঘটল যে দেশের মানুষ বই পড়লে দেশের সরকার রেগে যাবে? নিজেই নিজেকে বলেছিল ছেলেটি,”তাহলে আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না!”সেই থেকে সরকার বিরোধী মনোভাব এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি আগ্রহ জন্ম নিয়েছিল সেই ছেলেটির মনে,যার প্রতিফলন ঘটেছিল তার পেশাদার ফুটবল জীবনে এবং রাজনীতিতে। সারা পৃথিবীর ফুটবল প্রেমী জনতা জানে সক্রেটিস নামে গ্রীক দার্শনিকের সমনামী একজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার রয়েছেন যিনি বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকায় দেশের অধিনায়কত্ব করলেও ফুটবল প্রতিভা ও প্রতিবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেও পরিচিত। ব্যক্তিগত জীবনে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র খেলার মাঠে ঠাণ্ডা মাথায় নেতৃত্ব দিতেন মাঝমাঠ থেকে। খেলেছেন ১৯৮২ এবং ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। ইতিহাস সাক্ষী সর্বকালের অন্যতম সেরা টিম নিয়েও দুটি বিশ্বকাপে যথাক্রমে প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল ও কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিতে হয়েছিল জিকো,সক্রেটিস,ফালকাও জুনিনহো সমৃদ্ধ ব্রাজিলকে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন টিমের সদস্য না হলেও জিকো কে ই পেলের উত্তরসূরী এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ফুটবলার বলা হত যতক্ষণ না চার বছর পরে আর্জেন্টিনাকে কার্যত একক প্রচেষ্টায় ফুটবলের বিশ্বকাপ এনে দিচ্ছেন দিয়েগো মারাদোনা। সক্রেটিস অসাধারণ ফুটবলার হলেও কখনও তাঁর সঙ্গে জিকোর তুলনা করতেন না কোন কোচ বা বিশেষজ্ঞ। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তিনিই একমাত্র ফুটবলার যাঁকে ব্রাজিলে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচিত সরকার দ্বারা প্রশাসন পরিচালনা করার প্রথা ফিরিয়ে আনার পিছনে যে গণ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য মনে রাখা হয়। বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য না হয়েও একটা গোটা তরুণ প্রজন্মের কাছে দাড়ি এবং হেয়ার ব্যাণ্ড পরা সঙ্গে সক্রেটিসের ছবি তাঁর শৈশব ও যৌবনের আদর্শ ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গেভারার ছবির মতোই জনপ্রিয় ছিল। আর কোন ফুটবলার বাম গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থনে জনসভায় বক্তৃতা দেন নি। বেটাফিগো থেকে কোরিন্থিয়ানে যোগ দেওয়ার পরে দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছে মনে হওয়ার কারণেই ১৯৮৪ সালে সক্রেটিস ক্যাথিড্রাল চার্চ সংলগ্ন ময়দানে দু লক্ষ জনতার সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু না হলে ইতালির ফুটবল ক্লাবে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে ১৯৮৫ সালে ব্রাজিলে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। সক্রেটিস প্রেসিডেন্ট লুলার প্রতি তাঁর সমর্থন তিনি গোপন করেন নি। সক্রেটিসের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৃত্তান্ত ধরা আছে ক্রীড়া সাংবাদিক জুকা কুফৌরির লেখা “সক্রেটিস অ্যাণ্ড কোরেন্থিয়ানস ডেমোক্রেসি” বইতে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর চিকিৎসক সক্রেটিস হিসাবে সাও পাওলোর এক চিকিৎসাকেন্দ্রে যুক্ত হয়েছিলেন। ক্ষমতার রাজনীতির থেকে দূরেই ছিলেন তিনি। পেলে থেকে ভালদেরামা অনেকেই রাজনীতিতে এসেছেন কিন্তু বামপন্থী প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে একমাত্র সক্রেটিস সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

একই মহাদেশে মাত্র ছ বছরের ব্যবধানে ফুটবল মাঠের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশে জন্মেছিলেন দু জন এবং কি আশ্চর্য দুজনেই বামপন্থী চেতনার মানুষ । ফিদেল কাস্ত্রো,চে গেভারার অনুগামী। কিন্তু দুজনের জীবন যাপনেই বেপরোয়া ধরণ,তারই ফলশ্রতি ব্রাজিলের সক্রেটিস ও আর্জেন্টিনার দিয়েগো মারাদোনার অকাল মৃত্যু। সক্রেটিস চলে যান মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে এবং মারাদোনা ষাট বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই। খ্যাতি,প্রতিভা এবং বিতর্কে মারাদোনা অবশ্যই এগিয়ে কারণ তাঁর খেলার তুলনা হয় পেলের সঙ্গে অথচ কিংবদন্তি হয়েও ডোপিং,ড্রাগ,রেফারির চোখ এড়িয়ে হাত দিয়ে গোল করার বিতর্ক আজ তাঁকে নিয়েও স্মৃতি চারণেও উঠে আসে! সক্রেটিসের মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস হয়েছিল এসেছিল খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরে। কিউবার প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো র ঘনিষ্ঠ এবং ভেনেজুয়েলার মার্কিন বিরোধী প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো স্যাভেজের গুণমুগ্ধ দিয়েগো মারাদোনা প্রত্যক্ষভাবে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও ফিদেল কাস্ত্রোর পথটাই ঠিক এবং গরীব মানুষকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভালো রাখতে পারেনা,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কিছুই আমার পছন্দ নয় – জাতীয় বিবৃতিতে নিজের রাজনৈতিক প্রবণতা বুঝিয়ে দিতেন। ২০০৫ সালে ” স্টপ বুশ” লেখা টি শার্ট পরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন দিয়েগো। নিজের শৈশবের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করার সময় তিনি বলতেন, আমার দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবনে আমি দেখেছি গরীবদের বঞ্চিত করে কেমন করে রাজনীতিবিদ ও ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে যায়। প্রথম জীবনে আর্জেন্টিনার উদার গণতন্ত্রী কার্লোস মেনেমকে সমর্থন করেছিলেন মারাদোনা,সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্তও হয়েছিলেন কিন্তু জনসমর্থন পাননি। ১৯৮৬ সালে কিউবা সফরে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ হওয়া কমিউনিস্ট রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো দিয়েগোর জীবনে সবচেয়ে বড়ো আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন ১৯৯৪ সালে যখন ড্রাগে আসক্তি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। চার বছর কিউবায় থেকে নেশামুক্তি কেন্দ্রে কাটিয়ে মারাদোনা যে শুধু সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তাই নয়, ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যক্তিগত সান্নিধ্য ও স্নেহ তাঁর জীবনবোধেও পরিবর্তন এনেছিল। এই সহায়তার বিনিময়ে ফিদেল কাস্ত্রো কখনও তাঁর কাছে কিছু চান নি কিউবা ফুটবল দলের কোচিং করানোর প্রস্তাবও দেন নি। ২০১৬ সালের ২৬ শে নভেম্বর ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শোকে মুহ্যমান দিয়েগো মারাদোনা বলেছিলেন আমি আমার দ্বিতীয় পিতাকে হারালাম।

সক্রেটিস ও মারাদোনা দুজনেই নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরের বাইরেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। মারাদোনা ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজের কার্যকালে গরীব মানুষের জন্য যেসব উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মারাদোনা তা সমর্থন করেছিলেন। শুধু তাই নয় হুগো সাভেজের মৃত্যুর পরে তাঁর উত্তরসূরী নিকোলাস মাদুরোকেও তিনি সমর্থন করেন। ধনসম্পদের শিখরে পৌঁছে খেলোয়াড় ও শিল্পীদের রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার বা ক্ষমতাসীন শাসকদের সঙ্গে চলার সাধারণ প্রবণতা না থাকা এই দুজন সত্যিই ব্যাতিক্রম।