জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্র হত্যায় হেন অপরাধ নেই যা তিনি করেন নি। মুখোশের আড়ালে নির্বাচিত ছাত্র-সংসদের নেতৃত্ব কে রক্তাত্ত করার মত ঘৃণ্য কাজকে আড়াল করার ভূমিকা ছিল স্পষ্ট। শিক্ষার মানের বারোটা বাজিয়ে দক্ষিণপন্থীদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা, চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক বিকৃতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কে বিষাক্ত করে তোলা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অনুকরণীয় উচ্চমানকে পর্যুদস্ত করাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এইসব কিছুর পৌরোহিত্যে ছিলেন জেএনইউ-এর তৎকালীন উপাচার্য জগদীশ কুমার।

মোদী সরকার তাঁকেই ইউ জি সি চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ করেছে। উচ্চশিক্ষায় হিন্দুত্ববাদী অভিযানের পরিচালনায় তাঁর গুরুত্ব যেমন স্পষ্ট হয়েছে , তেমনই তাঁর এই অপরাধমূলক প্রবৃত্তির প্রয়োগও যে নিরবচ্ছিন্নভাবেই হবে তাও স্পষ্ট। কাজেই এর মধ্যে বিস্ময়ের কোনো অবকাশ নেই যে জগদীশ কুমার তার হস্তাক্ষরের প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে উচ্চশিক্ষায় হিন্দুত্ববাদী অভিযানের বর্শাফলক হিসাবেই কাজ করবে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ (আইসিএইচআর) একগুচ্ছ গবেষণাপত্র সংকলনকে স্বীকৃতি দিয়ে, জগদীশ কুমার একটি আনুষ্ঠানিক পরামর্শ পাঠিয়ে দিয়েছেন সমস্ত রাজ্যপালের কাছে। “ভারতবর্ষ; গণতন্ত্রের জননী “– এই শীর্ষকে রাজ্যপালরা আচার্য হিসাবে এই ধ্যানধারণাগুলি যাতে সক্রিয় প্রচারে ভূমিকা নেয়।  আইসিএইচআর গবেষণা পত্রের সংকলনটি এটাও পরিস্কার করে দিয়েছেন যে ইতিহাস গবেষণার শীর্ষ সংস্থাটি পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদী পদাতিক সেনাদের করায়ত্ত হয়ে গিয়েছে।

মোদীঃ রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা

সারা দুনিয়া জুড়েই তীক্ষ্ণ সমালোচনা হচ্ছে ভারতের। এটাই স্বাভাবিক, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সদ্য স্বাধীন উপনিবেশগুলিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ অনন্য। উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরুদ্ধের সংগ্রামের উত্তরাধিকার এই অনন্য অবস্থানের ভিত্তি। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রের ধারণার নির্যাসের সৃষ্টি সংবিধান এই অনন্য ভূমিকার অনুপ্রেরণা। সাম্প্রতিককালে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে যে তীব্র অভিযান সংগঠিত হচ্ছে মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, তা ভারত সম্পর্কে প্রবল সমালোচনার ঝড় তুলেছে। আন্তর্জাতিক এই সমালোচনাকে উপেক্ষা করা আর সম্ভব হচ্ছে না।

তাই আসরে নামতে হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদীকে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে প্রধানমন্ত্রী যা প্রচার করেছেন তাঁর প্রধান প্রতিপাদ্য- ‘ভারত গণতন্ত্রের জননী’। মোদী কখনোই তার আর এস এস-এ অংশগ্রহণের সম্পর্কে লুকোছাপা করেন নি। কিন্তু প্রাচীন ভারত সম্পর্কে এই বর্ণনা আমাদের ইতিহাস চেতনার উপর একটি প্রত্যক্ষ আক্রমণ। আর এই আক্রমণ সংগঠিত হচ্ছে প্রচীন ভারত সম্পর্কে সাভারকার এবং গোলওয়ালকারের অবাস্তব কল্পকথা আশ্রিত ইতিহাস পঠনকে সামনে রেখে।

এখন যেহেতু আরএসএসই রাজনৈতিক ক্ষমতার চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রন করে চূড়ান্ত অপব্যবহার ঘটিয়ে পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে, তারা মনে করছে ভারতের ইতিহাস বিকৃতি এবং পুননির্মাণ অসম্ভব নয়। সংকীর্ণতাবাদী ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ব প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে অন্তঃসার শূন্য করে তোলবার এটাই উৎকৃষ্ট সময়। এতে কারুরই বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আইসিএইচআর’র কনসেপ্ট নোটঃ ‘একটি অবিমিশ্র হিন্দুত্ববাদী দলিল’ 

আইসিএইচআর কনসেপ্ট নোটটির আঢ়ম্বরপূর্ণ শীর্ষক দিয়েছে “ভারত: লোকতন্ত্র কি জননী”। ভারত গণতন্ত্রের জননী। এই দলিলটির বৌদ্ধিক অনুসন্ধানের কোনো ভণিতা নেই। অথবা পরিশ্রম সাধ্য ইতিহাস গবেষণার। ইতিহাস বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসাবে বিকশিত হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কার বা জিন বিজ্ঞান প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে। স্বভাবতই আইসিএইচআর-এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণকে ঘৃণা ভরেই ব্রাত্য করেছে। এটাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে আমাদের অতীতে অনুসন্ধানের এই বিকৃতিকে আমাদের উচ্চশিক্ষার পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। তাই এরকম একটি ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি ব্যাপকতম মঞ্চ নির্মাণের জরুরী দাবী রাখছে আজকের সময়। এই প্রতিরোধ আমাদের সংবিধান ঐতিহাসিক ভিত্তি এবং বাস্তব ইতিহাসের বুনিয়াদকে সুরক্ষিত রাখবার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

কনসেপ্ট নোট :

শুরুতেই একটি অনৈতিহাসিক দাবী রেখেছে। ভারতীয়রা স্মরণাতীতকাল থেকেই সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে; ফলে ভারতবর্ষের ধারণাটাই উদযাপিত হওয়া উচিত। এই দাবীর যে কোনো বাস্তবিকতা নেই তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সাম্প্রতিকতম জিন গবেষণা এবং ডিএনএ বৈচিত্র্যের তথ্য থেকে এখন এটা সার্বজনীন ভাবেই প্রতিষ্ঠিত যে ভারতের অন্তর্মুখীন পরিযায়ীরা এসেছে। পুরোপুরি স্বকপোলকল্পিত এই কথন জরুরী ছিল , প্রাচীন ভারত থেকে বাণী পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার তত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রাচীন ভারতে আধুনিক গণতন্ত্রের শিকড় খুঁজতে গিয়ে তারা ‘আপন মনের মাধুরি’তে আপ্লুত হয়ে ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাস লিখনের উপর ভিত্তি করে ভারতের গ্রামীণ ব্যবস্থাকে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করেছে। ইতিহাস পাঠের এই বৈশিষ্ট্যই ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাস কথনের মূল উপজীব্য ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এর নেতৃত্ব দিয়েছেন চার্লস মেটকাফ, জেমস মিল, মাউন্টস্টুয়ার্ট এলফিনস্টো, হেনরি মেইন-এর মতো ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদরা।

 এই নোটের প্রধান তাত্ত্বিক প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে — “ভারতে বৈদিকযুগ থেকে দুইধরণের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল, জনপদ এবং রাজ্য। ভারতের অভিজ্ঞতা তার প্রসাশনের আপন বৈশিষ্ট্য গ্রাম এবং কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার স্পষ্টভাবে দেখা যায় ; I) যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কাঠামো সম্প্রদায়ে(গ্রামীণ সম্প্রদায়) থেকে বিযুক্ত ছিলো, II) গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলি ছিলো স্বশাসিত এবং স্বয়ম্ভূ, III) এবং স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির একটি স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল যেমন পঞ্চায়েত এবং খাপ। এগুলি এই স্বশাসনের কাঠামোকে বৃহত্তর রাজতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যগুলির প্রভাব থেকে মুক্ত রেখেছিল। বিশেষ করে, আক্রমণকারীদের সংস্কৃতির থেকে”।

এর থেকে বিস্ময়কর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না! কারণ, ভারতীয় গ্রামকেই সেই বুনিয়াদ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে অতীতের ঔপনিবেশিক ইতিহাস পাঠের ভিত্তি। আজ  গণতন্ত্রের উদযাপন হচ্ছে স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে! সুনির্দিষ্ট ভাবেই এই ধরনের ইতিহাসের পুননির্মাণ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপনিবেশবাদ বিরোধী উত্তরাধিকারের চূড়ান্ত পরিপন্থী আরএসএস-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে সযত্ন লালিত দূরত্বের বাস্তবতাকে আড়াল করতে গিয়েই “অমৃতকাল নিয়ে দ্বিচারিতা করছে আমাদের প্রাচীন অতীতের ‘ভিত্তিহীন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য’ প্রচার করবার জন্য”।

ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং তার অবিচ্ছেদ্য বর্ণাশ্রমের ধারণা 

ইউজিসির চেয়ারম্যান এই নোটটির উপস্থাপন করতে গিয়ে তার নিজস্ব কল্পনাকে ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক পাঠ বর্জন করতে। “অনেক লক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে ভারতীয় প্রাচীন প্রসাশনিক ঐতিহ্যে ভারত ছিল গণতান্ত্রিক। ভারতে রাজতন্ত্র ছিলো এই ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তে। প্রত্নতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক, মুদ্রা, ভক্তি ইত্যাদির ভিত্তিতে আরও সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের। রাকিঘড়ি ও সানৌলি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কার প্রমাণ করছে ভারতে জনগণের স্বশাসনের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার খ্রীস্টপূর্ব সময় থেকে। “এই দাবীর ভিত্তিতেই এবং কোনোরকম সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই নোট বলছে আমাদের অতীত “লোকতন্ত্র”, “প্রজাতন্ত্র”, বা “জনতন্ত্র”-‘র। এই অনৈতিহাসিক ধারণাকেই সম্প্রসারিত করে নোট আরও ব্যাখ্যা করেছে যে “সম্প্রদায়ের কল্যাণে পরিচালিত সম্প্রদায় ব্যবস্থা সূচক এই লোকতন্ত্র। “অন্যদিকে প্রজাতন্ত্র গণতন্ত্রের নিছক এবং জনতন্ত্রের তাৎপর্য “শাসক বনাম জনগণের ব্যবস্থা”।

এই ধরনের আজগুবি ব্যাখ্যার উপরে নোটটি দাবী করেছে যে প্রাচীন ভারত অনন্য, কারণ সেখানে কোনো স্বৈরাচারী বা অভিজাততান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলো না। ছিলো না জন্ম, সম্পদ বা রাজনৈতিক পদের ভিত্তিতে কেন্দ্রীভূত কোনো বৈষম্য। “ভারতীয় প্রসাশন ছিলো প্রাচীন রোম বা গ্রীসের থেকে ভিন্ন”। ভারতে সার্বভৌমত্বের ধারণার ভিত্তিটি হচ্ছে “ধর্ম”, যাকে নোটটি ব্যাখ্যা করছে “আইন” হিসাবে।

এই সমস্ত ব্যাখ্যার অন্তঃসলিলা ইতিহাস কথনের ঔপনিবেশিক উৎস ছাড়াও, নোটটি হিন্দু, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছে আমাদের অতীত কে ব্যাখ্যা করবার জন্য। বেদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রকল্পের ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে যে ধারণাগুলি তার নির্দিষ্ট অস্তিত্বের সাক্ষ্য প্রমাণ থাকলেও তাকে কার্যত অস্বীকার করেছে আইসিএইচআর-এর হিন্দুত্ববাদী মুখপত্ররা। তারা মরিয়া হয়েই ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী বিকল্প ধারাগুলিকে চেপে যাবার  চেষ্টা করেছে। এটাও স্পষ্ট যে নোটটি বৈদিক এবং হরপ্পা সংস্কৃতির পৃথক ধারাকে অস্বীকার করেছে, এবং এইগুলিকে অবিচ্ছেদ্য এবং পূর্ণাঙ্গ একটি ধারার অংশ হিসাবেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটাই সাভারকারের হিন্দুত্ব আশ্রিত ইতিহাস কথনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস এবং কল্পকথার পার্থক্যকে অস্বীকার করেই নোটটি ইতিহাস সম্পর্কে একটি সীমাহীন বিকৃত ধারণার পক্ষে ওকালতি করে বলেছে—”প্রারম্ভকাল থেকেই হিন্দু মন ভারতীয় বৈচিত্র্যের ব্যাপকতম প্রশ্নগুলির সূত্রবদ্ধ করার কেন্দ্রীয় প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবং একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের ভূ-সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।  ভারত রাষ্ট্র-এর ব্যাখ্যা করলে যে দেশের দক্ষিণে হিমালয়ের পর্বতমালা এবং উত্তরে মহাসাগর — “এটাই ভারত এবং ভারতীয়দের পরিচয়”। সাভারকার এবং গোলওয়ালকারের উচ্চারণ স্পষ্ট ! ঐতিহাসিক ব্রজ দুলাল চট্টোপাধ্যায় কার্যকরীভাবে এই কল্পিত ইতিহাস ব্যাখ্যাকে খন্ডন করে লিখেছিলেন যে ভারতবর্ষের আলোচনা এবং বোঝা পড়াকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ না টেনেই করা সম্ভব। ইতিহাসবিদ চট্টোপাধ্যায় এটাও দেখিয়েছেন যে সীমানা বা বিদেশি- এই সমস্ত ধারণাগুলি ভারতবর্ষ সংক্রান্ত চর্চায় প্রাচীন সূত্রগুলিতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল।

স্বভাবতই নোটটি আত্মপরিচয়কে, ‘অন্যদের’ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার দায়দায়িত্ব চাপিয়েছে বিদেশি আক্রমণকারীদের উপরই। এটা বর্ণাশ্রমের বৈষম্যবাদী কাঠামোকে অস্বীকার করার সচেতন প্রচেষ্টা। নোটে নির্দিষ্ট স্পষ্ট উদ্দেশ্য জাতপাতের বৈষম্য মূলক কাঠামোকে আড়াল করা। “ভারতীয় জনগণ শুরু থেকেই বৈষম্যহীন মনোভাবে সমৃদ্ধ ছিলো। বৈদিক সময় থেকে এটাই “লোকতন্ত্রিক” ঐতিহ্য। বলাই বাহুল্য আইসিএইচআর-এর এই ইতিহাস কথন আমাদের দেশের জাতপাত বিদির্ণ ইতিহাসে দলিত এবং অন্যান্য পশ্চাৎপদ সামাজিক অংশের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বদলে “গণতন্ত্র এবং প্রসাশনের বিকল্প শিকড় হিসাবে” উপস্থিত করা হয় শুধুমাত্র “ভারত গণতন্ত্রের জননী” এই অনৈতিহাসিক বিকৃতিকে বৈধতা দিতে।

আইসিএইচআর-এর নোটের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস কথনের প্রতিধ্বনি করে সমসাময়িক ভারতের সাংবিধানিক ‘ভারতীয়’ উৎস খোঁজার নামে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপনিবেশ বিরোধী উত্তরাধিকারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। মানবতা, দলিত এবং নারীদের বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধের ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার বাস্তবতাটিকেও আড়াল করা। স্পষ্টতই ধর্মশাস্ত্র এবং বৈদিকসূত্র অনুপ্রাণিত ইউজিসি চেয়ারম্যানের পরামর্শ ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কোনো চেষ্টাই করেনি।

সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রবাদী ধারণার বিরুদ্ধে নগ্ন আক্রমণ

ইউ জি সি চেয়ারম্যানের ভূমিকা আমাদের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রবাদের যে ভিত্তি রচনা করেছিল এবং বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেছিলো। –তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ইউ জি সি আইন, ইউ জি সি ক্ষমতার সংজ্ঞা হাজির করেছে—- I) “বিশ্ববিদ্যালয় পঠনপাঠন পরীক্ষা এবং গবেষণার মান নিরুপণ এবং চালু রাখা।  II) বিধি এবং নুন্যতম মান নির্ধারণ করা। III) কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার উপর নজরদারি করা।  বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্তরে শিক্ষার উপর অনুদান নির্ধারণ এবং বিতরণ করা”। ইউ জি সি আইন একাধিক পরিবর্তন স্বত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত নয়। স্পষ্টতই রাজ্য সরকারগুলি সংবিধান নির্দিষ্ট সুস্পষ্ট অধিকার এবং ক্ষমতা রয়েছে। ইতিহাসের উপর কোনেরকম শৈখ্যনিক এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়া আই সি এইচ আর-এর ইতিহাস সংক্রান্ত নোটটি নির্লজ্জ এবং অনুমোদন এবং পৃষ্ঠপোষকতা ইউ জি সি-এই উদ্যোগে রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। 

সংবিধান বর্ণিত নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির বিকল্প রাজ্যপাল নয়। সুতরাং ইউ জি সি চেয়ারম্যান সরাসরি রাজ্যপালদের এই বিষয় সেমিনার সংগঠিত করবার জন্য যেভাবে আইসিএইচআর-এর নোটটিকে ব্যবহার করেছেন তা রাজ্যের অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা। সাম্প্রতিককালে আমরা বিজেপি এবং আরএসএস পোষিত রাজ্যপালদের ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করছি। এর চূড়ান্ত কুৎসিত উদাহরণ কেরালার রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের ভূমিকা।এই ধরনের ঘটনা যে বিচ্ছিন্ন নয় বরং সামগ্রিকভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার একতরফা প্রচেষ্টা -এটাও স্পষ্ট। আর ইউজিসি চেয়ারম্যানের এই ফতোয়া সংবিধানের ব্যবস্থাপনাকে উপেক্ষা করার চরম অভিব্যক্তি।

উপসংহারের পরিবর্তে 

সাম্প্রতিকতম গবেষণায় হিটলারের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসকে পুননির্মাণের প্রচেষ্টাকে ইতিহাসবিদরা ‘স্মৃতির উপর আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছেন — “জার্মান সৈন্যদের অবসর কালীন কার্যকলাপের যে বিবরণ নৌ-সেনাদের রেকর্ড থেকে অধিকৃত ফ্রান্সে ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কিটেলের একটি নির্দেশ খুঁজে পাওয়া গেছে। ১৯৪০-এর ১২ আগস্ট এই নির্দেশনামার থেকে জানা যায় যে জার্মান সেনাবাহিনীর উচ্চতম নেতৃত্ব অধিকৃত বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমস্ত স্মারক স্তম্ভগুলিকে ধ্বংস করে ফেলার উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেয়। হিটলারের চোখে এই সমস্ত স্মারক স্তম্ভগুলির উদ্দেশ্য ছিলো জার্মান সেনাবাহিনীকে কালিমালিপ্ত করার। এবং জার্মান জাতির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো। সুতরাং এগুলির অবলুপ্তি জার্মানির ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির জন্য তাদের জাতীয় খ্যাতিকে সুরক্ষিত করাটা জরুরি”।

এটা কোনো কাকতালীয় আবিস্কার নয়। ফ্যাসিস্টরা বারে বারে স্মৃতির উপর আক্রমণ করে। ইতিহাস চেতনার উপরেও। এর উদেশ্য বর্ণবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অনান্য সংকীর্ণতাবাদী রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত কথনকে টিকিয়ে রাখা এবং দৃঢ় করার জন্য ঘৃণা এবং ‘অপরায়ণকে’ বৈধতা দিতে। একই ধরনের উদাহরণ, ওল্ড টেস্টামেন্টের  কল্পকথা জায়ণবাদীরা ব্যবহার করে ইতিহাস চেতনাকে ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে গড়ে তোলা ইজরায়েলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। এবং প্যালেস্তানিয়দের আভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক আক্রমণের শিকার করে নিজভূমে পরবাসী করবার জন্য। 

আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী যে সর্বাত্মক আক্রমণ আজ সংগঠিত হচ্ছে, স্পষ্টতই তার অনুপ্রেরণা হচ্ছে, অন্যত্র ফ্যাসিবাদীদের সম্মিলিত স্মৃতিকে আক্রমণ করার ইতিহাস থেকেই। ইউ জি সি সার্কুলার এই অগৌরবের ক্রুর ঐতিহ্যকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে।