১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হবার কয়েক বছরের মধ্যেই বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমিরাজস্ব নীতি, আর্থিক শোষণ সহ নানা কারণে ভারতের সাধারণ মানুষ কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ভারত ছিল কৃষি নির্ভর দেশ এবং ঔপনিবেশিক শোষণের প্রাথমিক ক্ষেত্র ছিল কৃষি। তাই মূলত কৃষিজীবী, অরণ্যজীবী, উপজাতিভুক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষই ওই বিদ্রোহগুলি সংগঠিত করে। কোম্পানির শাসন ও অত্যাচারের  বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সংঘটিত হয় চুয়াড়, ভীল, কোলি, কোল, সাঁওতাল বিদ্রোহ। আজ আলোচনা করব কোল সম্প্রদায়ের অংশ মুন্ডা উপজাতিদের বিদ্রোহ তথা ‘উলগুলান’ বিষয়ে।

‘উলগুলান’-এর অর্থ প্রচণ্ড বিদ্রোহ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৫ নভেম্বর মুন্ডা বিদ্রোহের অবিসংবাদিত নেতা বিরসা মুন্ডার জন্মদিন ছিল।

           অরণ্যবাসী মুন্ডাদের ছিল বন জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষবাসের উপযোগী করা জমির যৌথ মালিকানা। যে ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘খুঁন্তকাটি’ ব্যবস্থা। অর্থাৎ জল জঙ্গলের অধিকার নিয়ে বহমান ছিল আদিবাসীদের  জীবন। কিন্তু এই চিরাচরিত  আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় ভাঙন সৃষ্টি করল প্রথমত বহিরাগত ‘দিকু’ অর্থাৎ  জমিদার ও মহাজনদের শোষণ। এর সাথে যোগ হল অরণ্যের অধিকার হরণ আইন, ১৮৯৪ সালে বিদেশী ‘দিকু’ ব্রিটিশের আইন। যে আইনে মুন্ডারা তাদের বংশ পরম্পরায় বহাল অরণ্যের অধিকার হারিয়ে ফেলল। ‘দিকু’ কথার অর্থ শত্রু। দ্বিতীয়ত বেগার শ্রম। কখনো সখনো সামান্য মজুরির বিনিময়ে বেগার খাটানো। আবার জোরপূর্বক সুদূর আসামের চা বাগানেও তাদের খাটতে পাঠানো হত। তৃতীয়ত খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে লুথেরান, অ্যাংলিসাস, ক্যাথলিক মিশনারিরা মুন্ডা সমাজে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার  করতে আসে। এই প্রয়াস ছিল আদিবাসীদের স্বাধিকার ও সংস্কৃতিতে আঘাত স্বরূপ। সরলপ্রাণ মুন্ডাদের দারিদ্রের সুযোগে খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্ম প্রচার চলতে থাকে।

           ব্রিটিশ অরণ্য আইনে জমির অধিকার হারিয়ে মুন্ডা সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে তারা সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহে সামিল হয়। কে এই বিরসা মুন্ডা? একজন কিংবদন্তী নেতা। জন্ম ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই নভেম্বর পূর্বতন বিহার অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি জেলার রোহান্ডা জঙ্গলের কাছে চালকাদ গ্রামে। বাবা সুগানা মুন্ডা, মা করমী বাহাতু। বনে বাদাড়ে ঘুরে, পশুপালন করে, বাঁশি বাজিয়ে তার ছোটোবেলা কাটে। কোল ও মুন্ডা সর্দারদের বীরত্বের কাহিনি ও গৌরবের কথাগুলি শুনে ছোট্টো বিরসা চঞ্চল হয়ে উঠত। ১২ বছর বয়সে চাইবাসার  জার্মান লুথেরান মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন বিরসা। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি ও তাঁর পরিবার।থাকতে শুরু করেন চাইবাসায়। পড়াশোনায় তিনি খুব ভালো ছিলেন। একদিকে আদিবাসী স্বাধিকার অন্যদিকে মিশনারি ধর্ম ও শিক্ষার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করেন বিরসা। বৈষ্ণব গুরু আনন্দ পাঁড়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বৈষ্ণব ধর্মও গ্রহণ করেছিলেন। অবশেষে সমস্ত দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে আদিবাসী ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় ধর্ম ‘সার্না পন্থা’র অবতার হিসাবেই নিজেকে তুলে ধরেন।

            কিছুদিনের মধ্যেই  বিরসা হয়ে ওঠেন মুন্ডা সম্প্রদায়ের সবার কাছে ‘ধরতি আবা’ বা ভগবান। তাঁর অনুগামীদের বলা হয় ‘বিরসাইত’। তিনি মদ্যপান ত্যাগ, নির্মল চরিত্র ও গ্রাম গঠন, কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব ইত্যাদি মূল্যবোধে মুন্ডা সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেন। একইসাথে জমিদার-মহাজনদের মধ্যে আতংক তৈরি করেন তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুন্ডা সমাজকে সংগঠিত করে। ফলশ্রুতিতে ১৮৯৫ সালের ২৭শে আগষ্ট বিরসা ও তার কয়েকজন অনুচরকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ এবং দুই বছরের কারাবাস করতে হয় তাঁকে। এই গ্রেফতারি ক্ষোভের আগুন জ্বেলে দেয় মুন্ডাদের মনে। পাশাপাশি ওই সময়ে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে মুন্ডাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিরসা ছাড়া পাবার পরে ১৮৯৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর জ্বলে ওঠে দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের আগুন।

          দ্বিতীয় পর্বের মুন্ডা বিদ্রোহ আরো ব্যাপকতা নিয়ে সংগঠিত হয়। ১৮৯৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর ডোমবারি পাহাড়ে  মুন্ডা সমাবেশে বিরসা উদ্দীপক বক্তব্য রাখেন। ২৪শে ডিসেম্বর রাঁচি, চক্রধরপুরে জমিদার, মহাজনদের বাড়ি, কাছারি বাড়িতে ঝটিকা আক্রমণ চালায় বিরসার বাহিনী। চলে হত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ। জমিদারি-মহাজনি শোষণে শোষিত মুন্ডাদের শ্রেণিঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এইভাবেই। ব্রিটিশের সেনাবাহিনী ডোমবারি পাহাড়ে আক্রমণ শানায়। কমিশনার ফোর্বস ও ডেপুটি কমিশনার স্ট্রিটফিল্ড আদিবাসীদের ‘আবুয়া ডিসান’ (স্বতন্ত্র শাসন) ধ্বংস করতে নির্বিচারে গুলি চালান। কমপক্ষে ৪০০ জন আদিবাসী এই আক্রমণে নিহত হন। বিরসা পালিয়ে যান। ডোমবারি পাহাড়ের নাম হয়ে যায় ‘টপ্ড বুরু’ বা মৃতের স্তূপ।  ।

           কয়কদিন পর চক্রধরপুরের যমকোপাই বনে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত অবস্থায় বন্দি করা হয় বিরসাকে। তাঁর সাথে আরো ৫৭১ জনের বিচার হয়। ৩ জনের ফাঁসি হয়, ১৭ জনের হয় দ্বীপান্তর সহ কারাদণ্ড। ১৯০০ সালের ৯ই জুন মাত্র ২৫ বছর বয়সে কারারুদ্ধ বিরসাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। যদিও  বলা হয় কলেরায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

          রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নে মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেলেও ব্রিটিশ প্রশাসন বাধ্য হল ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রজাস্বত্ব আইন ফিরিয়ে আনতে এবং মুন্ডাদের ‘খুন্তকাটি’ প্রথার স্বীকৃতি দিতে। এছাড়া বেগার শ্রম প্রথার অবসান ঘটানো হল। ১৯১৪ সালে মুন্ডা বিদ্রোহের প্রভাবে ওঁরাও সম্প্রদায় ‘তানাভগৎ’ অর্থাৎ জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করে। বিশিষ্ট  রাজস্ব আধিকারিক আই এ এস কে কে সিং মুন্ডা বিদ্রোহ সম্পর্কে  মূল্যায়নে বলেছেন—“The movement  was agrarian in its root, violent in its means and political in its end.”

          বিরসা ব্যর্থ হলেও তাঁর আদর্শ আজও বেঁচে আছে। তাই তিনি মুন্ডা তথা আদিবাসী সমাজের কাছে আজও ভগবান। এই প্রসঙ্গে কে কে সিং-এর মন্তব্য  প্রণিধানযোগ্য—“No hero in munda folklore has been commemorate in such term as Birsa