সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে এই সময়ে সারা দেশে কয়েক লক্ষ ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে যেখানে একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল। এর ফলস্বরূপ, এই সেক্টরে  প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সরকারি উদাসীনতাই এই সংকটের প্রধান কারণ। কোভিড অতিমারির সময় ঢাক ঢোল পিটিয়ে এই ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ গুলি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে অর্থনৈতিক প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছিলেন তার বিন্দুমাত্র সুবিধাও এই উদ্যোগগুলি পায়নি। সরকারি সদিচ্ছার অভাবে বড় শিল্পে এমনকি রাষ্ট্রায়ত্তশিল্পেও (যারা মূলত এদের পণ্য ক্রয় করে) পড়ে থাকা হাজার হাজার কোটি টাকার বকেয়া উদ্ধার করা সম্ভব হলো না। ব্যাংক থেকে যে ঋণ দেওয়ার কথা এই প্যাকেজে ঘোষণা করা হয়েছিল, তা নেওয়ার ক্ষমতাও এই ছোট ও মাঝারি  উদ্যোগগুলির ছিল না।  একদিকে বাজার নেই উৎপাদন বন্ধ, অন্যদিকে মূলধনের সংকট– এই দুইয়ের  যাঁতাকলে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলির বড় অংশ। গত তিন-চার বছরে কয়েক লক্ষ ছোটো ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু মানুষ কাজ হারিযেছেন। শুধু মহারাষ্ট্রেই এধরণের কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা ৩০ লক্ষেরও বেশি। এই সময়ে শ্রম আইন সংশোধনের  নামে লেবার কোড চালু করার মধ্য দিয়ে এ ধরনের উদ্যোগের মালিকদের হাতে শ্রমিক ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধ করে দেবার একতরফা আইনি ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। ফলে নতুন নিয়োগ তো হলোই না উল্টে কাজ হারালেন বহু মানুষ। এই সংখ্যা আগামীদিনে আরও  বাড়বে সন্দেহ নেই। 

নভেম্বর ২০২২ সালে প্রকাশিত সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমির (সি এম আই ই) সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে  ভারতের বেকারির হার গত নভেম্বর মাসে ৮ শতাংশে পৌঁছেছে যা  অক্টোবরে ছিল ৭.৮ শতাংশ। গত এক বছরে বেকারির গড় হার ছিল ৭.৪ শতাংশ যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। কোভিড অতিমারির সময় এই হার ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। স্বাধীন ভারতে এ এক রেকর্ড বলা যেতে পারে। একদিকে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির ঠেলায় উৎপাদন ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে না। ফলে নিয়োগের ক্ষেত্র ক্রমে সংকুচিত হয়েছে, হবেও আগামী দিনে। সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে স্থায়ী নিযুক্তি বন্ধ থাকায় শূন্য পদের সংখ্যা বাড়ছে। অপরদিকে আর্থিক মন্দার জেরে, যাঁদের কাজ ছিল তাঁরাও কাজ হারাচ্ছেন– বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। স্বল্প মজুরির অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক  শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। কোভিডের সংকট মিটে গেলেও বেকারি ও  কাজ হারানো মানুষের সংকট মিটছে না বরং বাড়ছে।

শুধু ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই চলছে। তথ্য প্রযুক্তি ও পরিষেবা শিল্পে এই সংখ্যা বাড়ছে।  ভারতের ৫২ টি স্টার্ট-আপ সংস্থায় সাম্প্রতিককালে প্রায় ১৮ হাজার কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে বাইজু’স, চার্জবি, কার’স-২৪, লিড, মিশো, ওলা, এম পি এল, ইনোভেসার, উডান, আনএকাডেমি, ভেদান্তু প্রমুখ  সংস্থাগুলি। এর মধ্যে ১৫ টি ই-লার্নিং কোম্পানিতে ৭৮৬৮ জন কর্মীকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বছরে পাঁচটি ই-লার্নিং কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। শুইজি, জমাটোর মত খাবার সরবরাহকারি সংস্থাগুলিও কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে।

শুধু এ দেশে নয়, দুনিয়া জুড়ে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মাইক্রোসফ্ট, ফেসবুক, আমাজন প্রভৃতি যেসব সংস্থায় কাজ করার জন্য লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখতো, সেই কোম্পানিগুলিতেও অতি সম্প্রতি বিরাট সংখ্যক কর্মীকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটস এপ  ইত্যাদি সংস্থা গুলির মালিক মার্ক জুকেরবার্গ পরিচালনাধীন মেটা কোম্পানি ১১ হাজার কর্মীকে বসিয়ে দিয়েছে যা তার মোট কর্মচারীর ১৩ শতাংশ।  দুনিয়ার দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি জেফ বেজসের মালিকানাধীন আমাজন কোম্পানি ১০০০০ কর্মীকে বসিয়ে দিয়েছে যা তার মোট কর্মচারীর ৩ শতাংশ। দুনিয়ার পালা নম্বর ধনী ব্যক্তি এলন মাস্ক টুইটারের মালিকানা নেওয়ার পরেই ৩৭০০ কর্মীকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু তাই নয়, এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করায় কুড়ি জন পদস্থ আধিকারিক কে ছাঁটাই করেছে। ভারতে ও ভারতের বাইরে এই সংস্থাগুলিতে কর্মরত বেশ কিছু ভারতীয় এই ছাঁটাই-এর শিকার। জিম ফারলের পরিচালনাধীন ফোর্ড কোম্পানি ৩৫৮০ জন কর্মী ছাঁটাই করেছে। সত্য  নাদেলার পরিচালনাধীন মাইক্রোসফট কোম্পানিতে কাজ হারানো কর্মীর সংখ্যা ৩০০০ জন যার মধ্যে বেশ কিছু ভারতীয়ও আছেন। বাইজু রবীন্দ্রনের মালিকানাধীন বাইজু’স কোম্পানি এরমধ্যে ২৫০০ কর্মচারীকে ছাঁটাই করেছে। ব্লিনকিট কোম্পানি ১৬০০ জন ও ইউনিলিভার কোম্পানি দেড় হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে।

তথ্য প্রযুক্তি সংস্থায় কাজ হারানো এইসব ছেলেমেয়েরা আগের মত চাইলেই অন্য আরেকটি সংস্থায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যদিবা কোন সংস্থা নেয়, সেখানে স্থায়ী নিয়োগের জায়গায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে বেশি। অর্থাৎ চাকুরী বেতন কোন কিছুরই নিরাপত্তা থাকছে না আর। ছাঁটাই হয়ে যাওয়া ও মজুত প্রযুক্তিগত দক্ষতা লব্ধ কর্মীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, কর্পোরেট মালিকরা দরকষাকষির সুবিধা পুরোদস্তুর ভোগ করছে।

সরকার যদি এখনো সতর্ক না হয় এই সংকট বাড়বে আগামী দিনে। বিশেষ করে আমাদের মত দেশ যেখানে জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি, সেখানে এই সংকট মহামারীর আকার নেবে । শুধু নির্বাচনে জয় লাভের জন্য বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নয, চাই পরিকল্পিত সরকারি উদ্যোগ। ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদন, পরিষেবা ও পরিকাঠামো শিল্পে সরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে যা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। সর্বোপরি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বেকার সমস্যার সমাধানে সমন্বিত সরকারি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে ও তা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ  করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র  সহ সরকারি দপ্তর গুলিতে সমস্ত শূন্য  পদে দ্রুত নিয়োগের বন্দোবস্ত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণের প্রশ্নে সরকারকে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রের উন্নতি ও শিল্পের সম্প্রসারণ—এ দুয়ের ভারসাম্য রক্ষা করেই কর্মসংস্থানের সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে।