ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হল ,তার প্রায় সবটাই হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবিরের পক্ষে গিয়েছে। পাঞ্জাব এ যদিও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির মূল প্রতিভূ বিজেপি সরকার গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেনি ।তবুও সেখানে যে দলটি গরিষ্ঠতা লাভ করেছে ,সেই আম আদমি পার্টির সার্বিক কার্যকলাপ বিজেপির প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আগামী দিনে কতটা ইতিবাচক হবে, তা ধীরে তাদের কার্যকলাপ নিরিখে এখন থেকেই একটা বড় রকমের সন্দেহ প্রকাশ করতে পারা যায়।বিজেপির কাছে এই পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্ন টি ছিল তাদের কাছে প্রায় লাখ টাকার বিষয়।দীর্ঘকাল ধরেই ভারতের রাজনীতির গতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ একটা বড় ভূমিকা পালন করে আসছে ।কংগ্রেস আমলে উত্তরপ্রদেশের যে ভূমিকা ছিল, পরবর্তীকালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বা বর্তমান সময়ে, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে উত্তরপ্রদেশের সেই ভূমিকাটি আরো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে উত্তরপ্রদেশে।


সেই রাজ্যে বিজেপি ২০১৭ সালের নির্বাচনে জিতে এমন একজনকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বেছে নেয়, যাকে ঘিরে আরএসএসের হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিবর্তন একটা নতুন মাত্রায় ঘোরাফেরা করছে। প্রকৃতপক্ষে অটলবিহারি বাজপেয়ি হিন্দু সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে যে ধারায় উপস্থাপিত করেছিলেন, তাকে সময়ের নিরিখে আরও শক্তিশালী করার জন্যই, ২০১৪ সালে বিজেপি বেছে নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদিকে।নরেন্দ্র মোদিকে বেছে নিয়ে যেভাবে বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিলক্ষিত হয়েছে, তার লক্ষ্যে কিন্তু সবসময় কাজ করে গেছে তাদের মূল সংগঠন আরএসএসের যে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা, সেই ভাবনার প্রয়োগ এবং প্রসারের ক্ষেত্রে। মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় কালে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০১৭ সালে যাঁকে বেছে নিয়েছিল, সেই আদর্শপ্রয়োগে ,’ যোগী ‘ আদিত্যনাথ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের কাছে নতুন কোন পোস্টার বয় হয়ে উঠে উঠবে কিনা, সেই প্রশ্নটি এখন রাজনৈতিক মহলে ঘোরাফেরা করছে।হিন্দু সম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনাকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়ে, গোটা দেশজুড়ে সামাজিক বিভাজনের মাটিকে একটা বল্গাহীন করে তোলার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির যে ভূমিকা ,সেই ভূমিকাকে আরো ক্ষিপ্র করে তোলার ক্ষেত্রে, গোটা হিন্দু সম্প্রদায় শিবিরের কাছে এই স্বঘোষিত ‘ যোগী’ আদিত্যনাথ এখন বিশেষ সমাদরের মানুষ।


নাগরিক সমাজের উন্নয়নের প্রশ্নে গত পাঁচ বছর উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় থেকে এই স্ব ঘোষিত ‘যোগী ‘ আদিত্যনাথৃর শাসনকালে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা উত্তরপ্রদেশে এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র কোন অগ্রগতি ঘটেনি। অতীতে যে সীমাবদ্ধ উন্নয়ন উত্তরপ্রদেশে ঘটেছিল, সেইসব পাবলিক সেক্টরে ,সেগুলিও এই স্বঘোষিত যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে কার্যত ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে।
বিগত দুই বছরে কোভিদ পরিস্থিতির সময় গোটা উত্তরপ্রদেশে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা কোন জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার ছবি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ।খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচন কেন্দ্র ,বারাণসীর গঙ্গা দিয়ে কোভিডে মৃত মানুষদের মৃতদেহ ঘিরে যে ভয়াবহ ছবি সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে ,তা ভারতের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে অত্যন্ত বেদনার ,হতাশার, এবং লজ্জার বিষয় হয়ে উঠেছে ।অথচ এই বিষয়গুলি সম্পর্কে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন যোগী আদিত্যনাথের সরকারের কোনো হেলদোল ছিলনা।উত্তরপ্রদেশে বিজেপি জয়, সেখানকার বিজেপি সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতা ঘিরে সাধারণ মানুষের কোন অভিমত প্রকাশ নয় ।আসলে গত পাঁচ বছর ধরে স্বঘোষিত যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশে যে সরকার পরিচালিত হয়েছে ,সেই সরকারের কোনো রকম প্রশাসনিক অভিমুখ ছিল না। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা গুলি প্রতি আদিত্যনাথের সরকারের এতোটুকুই নজর কখনো ছিল না। লকডাউনের সময়কালে উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থায় একেবারে ধসে পড়েছিল।স্বাস্থ্যব্যবস্থা একেবারে ধসে পড়েছিল।কাফিল খানের ঘটনা আর নতুন করে মানুষকে বলবার দরকার নেই।


অতিমারীর প্রকোপে সাধারণ মানুষ সেখানে অর্থনৈতিকভাবে এতটাই দুরবস্থার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে যে ,তাঁদের জীবনযাত্রা ভয়াবহ দুর্বিষহ অবস্থার ভেতর দিয়ে চলছে ।গ্রামীণ উত্তরপ্রদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুরবস্থা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার করোনাকালে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার যে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন ,সেটিও সার্বিকভাবে গরিব মানুষ পান নি।কেন্দ্রীয় সরকারের রেশন বন্টনের ক্ষেত্রেও ভয়ঙ্কর রকম ভাবে ধর্মীয় সমীকরণকে কাজে লাগিয়েছে গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ।কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিনামূল্যে রেশন দেয়ার প্রকল্পগুলি ভেস্তে দিয়ে সেগুলির ভিতরেও বিভাজনের রাজনীতি আনতে, রেশন ডিলার দের জন্যে মানুষ রেশন পাচ্ছে না- এইরকম একটি ভাবনা গ্রামীণ উত্তরপ্রদেশের মানুষদের মধ্যে তীব্রভাবে প্রচার করে গিয়েছে বিজেপি। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছিল যে , তারা জনবাদী নীতি নিয়ে চলছে। কোভিদ পরিস্থিতিতে মানুষের সমস্যা অর্থনৈতিক সংকট- এগুলোর মোকাবিলায় তারা অনেকটাই আন্তরিক। কিন্তু একটা বড় অংশের ব্যবসাদারদের অসহযোগিতার ফলে তাদের সেই সমস্ত জনহিতকর পরিকল্পনাগুলি প্রবাহিত হতে পারছে না।


আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে , আর এস এসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি নিজেদের সামাজিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী ফোড়ে সম্প্রদায় একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ধীরে ধীরে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক বিস্তার যেভাবে ঘটিয়েছে তার সঙ্গে তাল রেখেই এই মধ্যস্বত্বভোগী ফোড়ে সম্প্রদায়ের বিজেপির প্রতি সমর্থনের পরোয়া না করে ,ক্রমশ বৃহৎ বুর্জোয়াদের দিকে নিজেরা ঝুঁকেছে । বৃহৎ বুর্জোয়াদের দিকে সঙ্গে নিজেরা একটা বড় রকমের বোঝাপড়া তৈরি করে নিয়েছে। যেমনটা অতীতে কংগ্রেস টাটা, বিড়লা,বাজাজ ইত্যাদি বৃহৎ বুর্জোয়াদের সঙ্গে করেছিল এবং সেটা এখনো ক্ষীণ হলেও কংগ্রেস বজায় রাখে।এইভাবে জন মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের সামাজিক মেরুকরণের যে রাস্তাটা ,সেই রাস্তা টাকে কিন্তু আরো বেশি বেশি করে মসৃণ করে তুলেছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। সামাজিক মেরুকরণের হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির এই প্রচেষ্টার পাশাপাশি এটা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি উত্তরপ্রদেশের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বহু ক্ষেত্রে জাতপাত ভিত্তিক তাসটি এমনভাবে খেলেছে, যাতে আখেরে লাভ হয়েছে বিজেপির।


মায়াবতী দল বহুজন সমাজ পার্টি, রাজনৈতিকভাবে বিজেপি জোটে ছিল না ।কিন্তু তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল বিজেপির প্রতি বিশেষ রকমের সহানুভূতিশীল ।মুখে বিজেপির বিরোধিতা করলেও প্রায় ৭৫ টি আসনে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে জাতপাতের খেলাটাকে তারা এমন ভাবে খেলে যা আখেরে বিজেপিকে বিশেষ রকম ভাবে সাহায্য করেছে।
পাশাপাশি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে ,রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কংগ্রেস দল উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী সংগ্রামের লড়াইটা দিতেই কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপির ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া দরকার ছিল, কংগ্রেস কখনোই উত্তরপ্রদেশের তেমন অবস্থান নেয় না বিগত প্রায় কয়েক দশক ধরে ।কংগ্রেস যে উত্তরপ্রদেশে নরম সম্প্রদায়িকতা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছে ,তা কংগ্রেসের পক্ষে আদৌ ইতিবাচক কোনো অবস্থান তৈরি করছে না ।বরংচ কংগ্রেসের সেই অবস্থান আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শক্তি যোগাচ্ছে ।


মুলায়ম সিং যাদব এর সমাজবাদী পার্টি ,তারা তাদের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে এখনও কতটা স্তিত আছে ,সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তারা এখনও কতখানি আন্তরিক, এই প্রশ্নগুলি কিন্তু নানাভাবে উত্তরপ্রদেশের জনমানুষের পড়তে শুরু করেছে। আরএসএস অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক সমাজবাদী পার্টি সম্পর্কে অরাজনৈতিক প্রচার এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সমাজবাদী পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা ঘিরে একটা প্রশ্নের জায়গা তারা তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে । বিজেপির সমীকরণের রাজনীতি বিভাজনের রাজনীতি র মোকাবিলা করার প্রশ্নে সমাজবাদী পার্টি যতটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাজনৈতিক মোকাবিলা করা সম্ভব, সব ক্ষেত্রে তারা সেটা করে উঠতে পারেনি। ফলে বিজেপির যে ধর্মান্ধ মেরুকরণের রাজনীতি, সেই মেরুকরণের রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনে তাদের সাফল্য এনে দিতে সক্ষম হয়েছে। সমাজবাদী পার্টির পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচার করেছেন ঠিকই , কিন্তু উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণের রাজনীতি স্বপক্ষেই বিভিন্ন মন্দিরে যাওয়া ,ধর্মীয় আচার আচরণ করা, ধর্মীয় প্রতীক ধারণ করা ইত্যাদি সত্ত্বেও বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি কে ছাপিয়ে মমতার মেরুকরণের রাজনীতি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী যুদ্ধে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। বলা যেতে পারে ,সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে পা রাখার জন্যে মমতার যে দৌড়, আগামী লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখবার জন্যে মমতার উদ্যোগ-আয়োজন ,সে সমস্ত কিছুই উত্তর প্রদেশ বিধানসভা ভোটের সময় মমতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ,বিশেষ করে বিভিন্ন মন্দিরগুলিতে যাওয়া ,সেখানে ধর্মীয় আচরণ করা, সেগুলির জোরদার প্রচার করা -এগুলি তাকে কতখানি মাইলেজ দেবে তা ঘিরে এখন থেকে জোরদার সন্দেহ প্রকাশ করতে পারা যায়। একজন ব্যক্তি হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্যই কোন না কোন ধর্ম পালন করবার অধিকার আছে ,যদি তিনি ধর্মে বিশ্বাস করেন। কিন্তু সেই ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করার ক্ষেত্রে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া একজন প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব যখন প্রকাশ্যে কোনো রকম আচার আচরণ করেন এবং সেই আচার-আচরণ গুলিকে প্রচারমাধ্যমে সামনে তুলে ধরেন ,তখন সেটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে কার্যত অমান্য করার সমতুল্য হয় ।


এই জায়গা থেকেই পশ্চিমবঙ্গে হিজাব পরে মমতার ফটো শুট করা, আর উত্তরপ্রদেশে গিয়ে বিভিন্ন মন্দিরে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা ,নানা রকমের ধর্মীয় আচার ইঙ্গিতে নিজের আচার-আচরণকে পরিচালিত করা- এই সমস্ত কিছুই আরএসএসের যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, তাকে উস্কে দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া লাগানোর একটি উদ্যোগ।