৩রা অক্টোবর ভারতের গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার ইতিহাসে একটি কালো দিন। দশজন সাংবাদিককে একসঙ্গে   নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছাড়াই গ্রেফতার করে  বিজেপি সরকার সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিল, মুখে যাই বলুক প্রকৃতপক্ষে তারা সংবাদ মাধ‍্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। নিউজ ক্লিক নামে ওয়েব পোর্টালের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ   ও প্রশাসনিক আধিকারিক অমিত চক্রবর্তীসহ   যে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁরা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির সমালোচক হিসাবে পরিচিত, শিল্পপতি আদানিদের দুর্নীতি,দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস‍্যা,দ্রব‍্যমূল‍্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে তথ‍্যভিত্তিক সাংবাদিকতায় অভ‍্যস্ত। সম্প্রতি জাতিভিত্তিক জনগণনার সপক্ষেও তাঁরা কলম ধরেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ইউ এ পি এ আইন প্রয়োগ করা হয়েছে।  দিল্লি পুলিশের   দশ ঘন্টা জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছিল নিউজ ক্লিকের উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক খ‍্যাতি সম্পন্ন  প্রবীণ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাকেও। দিল্লিতে ক‍্যানিং রোডে  সিপিআই(এম) এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির জন‍্য বরাদ্দ সরকারি বাসভবনে দিল্লি পুলিশ গিয়ে  বসবাসকারী এক পার্টিকর্মীর পুত্র যিনি নিউজক্লিকে কর্মরত,তাঁর মোবাইল ফোন ও ল‍্যাপটপ নিয়ে যায়। অপরাধের প্রমাণ ছাড়া এ হেন পুলিশি হানার  বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিছুদিন আগেই তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, বিজেপি বিরোধী I.N.D.I.A মঞ্চ আসলে পিছন থেকে পরিচালনা করে “আরবান নকশাশ “রা। সংসদে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আরবান নকশাল কারা সেই সংজ্ঞা প্রধানমন্ত্রী নিজে  বা তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সঠিকভাবে না দিতে পারলেও বক্তৃতায় আরবান নকশাল তকমা লাগিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র এবং মানবতার পক্ষে আওয়াজ তোলা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তচিন্তার প্রচারকদের আক্রমণ করতে ভুল করেন না। এক্ষেত্রেও তার ব‍্যাতিক্রম ঘটে নি।শুধু নিউজ ক্লিক ওয়েবসাইট নয়,গত ৩রা অক্টোবর  প্রায় পঞ্চাশ জন সাংবাদিকদের বাড়িতে দিল্লি পুলিশ তল্লাশি চালায়। নয়ডা, গুরগাঁও,গাজিয়াবাদ ছাড়াও সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদের মুম্বাইয়ের বাড়িতে এই তল্লাশি চলে। গত ১৭ ই আগষ্ট দায়ের হওয়া একটি এফ আই আরের ভিত্তিতে এই তল্লাশি অভিযান হয়েছে। ধর্ম ভাষার ভিত্তিতে সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছাড়া “সন্ত্রাসের সঙ্গে যোগাযোগের “ধারাও যুক্ত করা হয়েছে। বিজেপি ও দিল্লি পুলিশ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে নিউজ ক্লিকের পরিচালনায় ঘুরপথে চিনের টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। গত আগষ্ট মাসে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল যে ভারতে নিউজক্লিক সংস্থায় মার্কিন তথ‍্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সংস্থার কর্ণধার  নেভিল রয়  সিংঘমের সংস্থা মারফত অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে চিনের সপক্ষে প্রচার করার জন‍্য – এই অভিযোগে তল্লাশি চালানো হলেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।  ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে প্রবীর পুরকায়স্থ বলেছিলেন প্রয়োজনে আদালতে তাঁরা প্রমাণ দিতে রাজি আছেন এই অভিযোগ মিথ‍্যা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, গত ২০২১ সাল থেকেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিউজ ক্লিক ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে চিন সরকারের প্রচার করার অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে।

সংসদেও বার বার বিজেপির পক্ষ থেকে এই সংস্থার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হলেও কোন কিছুই প্রমাণ করা যায় নি। নাগরিকত্ব প্রমাণের আইন এন আর সি সি এ এ র প্রচলনের  প্রক্রিয়া শুরু করলে দেশ জোড়া প্রতিবাদী আন্দোলন হলে তখনও নিউজক্লিক সরকারের সমালোচনা করেছিল বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দপ্তর আরও বেশি তৎপল হয়ে উঠেছিল। টাইমস অফ ইণ্ডিয়া ছেড়ে নিউজ ক্লিকে যোগ দেওয়া সাংবাদিক  ভাষা সিং,শহীদ সফদার হাসমির ভাই সমাজকর্মী সোহেল হাসমি সহ অভিসার শর্মা, উর্মিলেশ,কৌতুকাভিনেতা সঞ্জয় রাজাউরাকে আটক করা হয়েছে। সবাই কোন না কোনভাবে নিউজ ক্লিকের সঙ্গে যুক্ত।

ইউ এ পি এ ধারায় আটক করার প্রধান উদ্দেশ‍্য যাতে অভিযুক্তদের  বিনাবিচারে আটক রাখা যায়।

বড়ো আশ্চর্য ব‍্যাপার পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তের প্রধান অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের  এই তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ মানুষের অধিকার ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার   আন্দোলন করা প্রধানমন্ত্রীর চিহ্নিত তথাকথিত “আরবান নকশাল “রা কিভাবে কোথায় আছেন সবাই জানেন। তালিকাটি বেশ দীর্ঘ । এঁদের মধ‍্যে ফাদার স্ট‍্যান স্বামী পুলিশ হেফাজতে প্রয়াত হয়েছেন,কবি ভারভারা রাও গুরুতর অসুস্থতার কারণে সাময়িকভাবে জামিন পেয়েছেন। কিন্তু জ্যোতি রাঘব জগতাপ, সাগর তাতিয়ারাম গোরখে, রমেশ মুরলীধর গায়কোর, সুধীর ধাওয়ালে, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, মহেশ রাউত, সোমা সেন, রোনা উইলসন, অরুণ ফেরেইরা, সুধা ভরদ্বাজ, ভারভারা রাও, ভার্নন গঞ্জালেস, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, গৌতম নওলখা, হানি বাবু, আর ফাদার স্ট্যান স্বামী।

উমর খালিদ, মীরন হায়দার, সফুরা জারগর, আসিফ ইকবাল তনহা, গুলফিশা ফতিমা, নাতাশা নারওয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা, শারজিল ইমাম।  এঁরা ফ‍্যাসিবাদি শাসন প্রতি  শ্বাসপ্রশ্বাসে  টের পাচ্ছেন।