আজ লেনিনের জন্মদিন। সারা বিশ্বজুড়ে আজ লেনিনকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন অজস্র মানুষ। হচ্ছে তাঁকে নিয়ে কতশত আলোচনা। কারণ তিনি যে বিশ্বের বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার কারিগর। বিশ্ব কমিউনিষ্ট আন্দোলনের এক মহান আইকন। এহেন লেনিন সমাজতান্ত্রিক তথা কমিউনিষ্ট আদর্শের প্রসারে জনশিক্ষার কাজকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ সমাজতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হল সামাজিক শ্রেণিভেদ মুছে ফেলায় সাহায্য করা। এই শিক্ষাব্যবস্থার আরো কাজ হল উৎপাদনের জন্য শুধু কর্মী তৈরিই নয়, উৎপাদনের উপকরণের ওপর সর্বজনীন মালিকানার  সমান অংশীদার এবং সমৃদ্ধচিত্ত মানুষ তথা ‘সমাজতান্ত্রিক মানুষ’ গড়ে তুলতে সহায়তা করা। সমাজের প্রয়োজন অনুসারে বিজ্ঞানের পরিকল্পিত বিকাশ ও বৈজ্ঞানিক কর্মীবাহিনী তৈরি করে সমাজতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল জনসাধারণের পক্ষে প্রয়োগের আয়োজন করে।পুঁজিবাদে পুঁজিপতিরা আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার বিষ্ময়গুলোকে মুনাফা সৃষ্টির কাজে লাগায়, এর বিপরীতে সমাজতন্ত্র কাজে লাগায় সমগ্র সমাজের কাজে। তাই মহামতি লেনিন বলেছেন, “পুরনো আমলে মানুষের প্রতিভা, মানুষের মস্তিষ্ক সৃষ্টি করেছিল শুধু কিছু লোককে প্রযুক্তিবিদ্যা ও সংস্কৃতির সুফল  দেয়ার জন্য এবং অন্যদের ন্যূনতম অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী, শিক্ষা ও বিকাশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য।এখন থেকে বিজ্ঞানের সমস্ত বিষ্ময় ও সংস্কৃতির অর্জনগুলো সামগ্রিকভাবে জাতির সম্পত্তি এবং আবার কখনো মানুষের মস্তিষ্ক ও মানবপ্রতিভা নিপীড়ন ও শোষণের জন্য ব্যবহৃত হবে না।” তাই সমাজতন্ত্রে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যের সঙ্গে জনশিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আজ লেনিনের মতো বিপ্লবী, তুখোড় তাত্ত্বিক নেতার জন্মদিনে তাই আলোচনা করব জনশিক্ষার কাজে তাঁর ভাবনা ও অবদান নিয়ে।

            সংস্কৃতি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে কমরেড লেনিন এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। যেগুলি বিধৃত রয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখা, বক্তৃতার মুদ্রিত রূপ তথা ‘জনশিক্ষা’ শীর্ষক সংস্করণে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব তথা নভেম্বর বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে গড়ে ওঠা রাশিয়ার সাবেকি স্কুল ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয়ে সোভিয়েত স্কুল ব্যবস্থা গড়ে ওঠার প্রথম বছরটি ছিল গোটা জনশিক্ষা ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পুনর্গঠনের বছর, সাবেকি স্কুল ব্যবস্থার ত্রুটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামের বছর। নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রথম বছরেই স্কুল ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে বিরাট অগ্রগতি ঘটে তার মূল্যায়নের জন্য নভেম্বর বিপ্লবের প্রাক্কালে রাশিয়ার স্কুলগুলোর ও বুনিয়াদি শিক্ষার অবস্থা কীরকম ছিল তার সংক্ষিপ্ত একটি চালচিত্র দেওয়া প্রয়োজন। নভেম্বর বিপ্লবের কিছু আগে ১৯১৩ সালে চতুর্থ রাষ্ট্রীয় ‘ডুমা’য় বলশেভিক প্রতিনিধিদের ভাষণের  খসড়া রচনা প্রসঙ্গে আর জার শাসিত রাশিয়ায় জনশিক্ষার শোচনীয় অবস্থার বর্ণনায় লেনিন লিখেছিলেন—‘জনসংখ্যার ২২ শতাংশ বিদ্যালয়ে যাবার বয়সী কিন্তু মাত্র ৪.৭ শতাংশ বিদ্যালয়ে যায়-সেটা হল মাত্র এক পঞ্চমাংশের সামান্য বেশি!! তার অর্থ রাশিয়ায় শিশু আর যৌবনোন্মুখ কিশোরদের প্রায় চার পঞ্চমাংশ জনশিক্ষা থেকে বঞ্চিত!!’ সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই হিসেব তুলে ধরে লেনিন সিদ্ধান্ত টানেন, ‘এত বর্বর এবং যেখানে জনগণের প্রধান অংশ শিক্ষা, আলোক আর জ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন মাত্রায় লুন্ঠিত এমন দেশ আর নেই-এমন  দেশ ইউরোপে আর থাকে নি, রাশিয়া ব্যতিক্রম।—রাশিয়ার সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা উঠতি প্রজন্মের চার-পঞ্চমাংশের ভাগ্যে নিরক্ষরতা অবধারিত করে দিয়েছে।’

      বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ার স্কুল ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সামাজিক অধিকার ভেদ, রাশিয়ার অধিবাসী অন্যান্য অসংখ্য জাতির পীড়ন এবং স্ত্রী-পুরুষের অসাম্যের নীতিতে।

         প্রতিটি সামাজিক সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা ও নির্দিষ্ট ধরনের স্কুল ছিল। অভিজাত সম্প্রদায়ের জন্য সামরিক মধ্য বিদ্যালয় (ক্যাডেট কোর), রাজসেবা কোর, সম্ভ্রান্ত কুমারীদের শিক্ষালয়, যাজকদের জন্য আধ্যাত্মিক সেমিনারি, আধ্যাত্মিক শিক্ষায়তন। আর কৃষক, কারুজীবী, শ্রমিকদের জন্য গির্জার দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্যারিস স্কুল ও তিন-চার বছর পাঠের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়।

        রাশিয়ার প্রত্যন্ত প্রদেশগুলিতে বাস করত অ-রুশ জাতিসত্তা। সেখানে আদপে কোনো স্কুলই ছিল না। বাশকির, ইয়াকুৎ, তুর্কমেন, উজবেক, কিরগিজ প্রভৃতি জাতির মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল বড়োজোর ১ থেকে ২ শতাংশ। কোনো কোনো জাতিসত্তার ক্ষেত্রে এমনকি শতাংশের দশমিক ভাগ।

        জার সরকার নারী শিক্ষার প্রসার চাইতো না। তাই  বিশ্ববিদ্যালয়ে ও টেকনিক্যাল উচ্চ শিক্ষায়তনে মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ১৮৯৭ সালের সারা রুশ আদমসুমারিতে মেয়েদের সাক্ষরতার হার পুরুষদের প্রায় তিনগুণ কম ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাচ্যের জাতিগুলির মধ্যে সাক্ষর নারী প্রায় ছিলই না। ১৮৯৭ সালের আদমসুমারি অনুসারে ৯ ও তদূর্ধ্ব বয়সের অধিবাসীদের মধ্যে সাক্ষর ছিল মাত্র ২৪ শতাংশ।

        সাবেকি স্কুল প্রসঙ্গে লেনিন কমিউনিষ্ট যুব লীগের তৃতীয় কংগ্রেসে বলেন, ‘এইসব স্কুলে শ্রমিক-চাষিদের তরুণ প্রজন্মকে যতটা না মানুষ করে তোলা হত, তার চেয়ে বেশি তাদের তালিম দেওয়া হত বুর্জোয়ার স্বার্থে। এমনভাবে তাদের গড়ে তোলা হত যাতে তারা বুর্জোয়ার যুৎসই চাকর হতে পারে, তার শান্তি ও আলস্যের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে মুনাফা তুলতে পারে তার জন্য।’

       শুষ্ক আনুষ্ঠানিকতা, প্রধানত যান্ত্রিক মুখস্থবিদ্যার ওপর জোর, ছাত্রদের একই ছাঁচে ঢালা-এই ছিল তখনকার শিক্ষাদান ও লালন পালন পদ্ধতির প্রধান কথা।

     তবে সাবেকি স্কুলের শুধু এই ত্রুটিগুলো দেখে তার সদর্থক দিকটা উপেক্ষা করলে ভুল হবে। এই প্রসঙ্গে লেনিন লিখেছিলেন, ‘বলা হয় যে, সাবেকি স্কুল ছিল ঠেসে মাথা বোঝাই করার, না বুঝে রপ্ত করার, মুখস্থ করার স্কুল। সে কথা ঠিক, তবে পুরনো স্কুলের কোনটা খারাপ আর কোনটা আমাদের কাছে উপকারী  তার তফাত করতে পারা চাই, কমিউনিজমের পক্ষে যা আবশ্যক সেটা তার মধ্যে থেকে বেছে নিতে পারা চাই।’

        অর্থাৎ লেনিন সাবেকি স্কুল প্রসঙ্গে দ্বান্দ্বিকভাবে এগোবার নির্দেশ দেন, সাবেকি স্কুলের অভিজ্ঞতার প্রতি সঠিক মনোভাব গ্রহণ করতে শেখান। কেননা প্রাকবিপ্লব রাশিয়ার ভালো স্কুলগুলোর সদর্থক দিক ছিল তাদের পাঠবর্ষের একটি পরিপাটি ব্যবস্থা, স্কুল জীবনের সুবিন্যাস, শিক্ষার্থীদের শৃংখলা ও নিয়মানুবর্তিতার তালিম ইত্যাদি। প্রাকবিপ্লব রাশিয়ায় স্কুলের ব্যাপারে সংগ্রাম চলেছিল দুটি প্রবণতার মধ্যে-একদিকে ছিল জারতন্ত্রের নীতির প্রকাশ স্বরূপ প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতা-রাজতন্ত্র, ধর্ম ও বড়ো আকারের রুশ শভিনিজমের প্রচার, অন্যদিকে ছিল প্রগতিশীল প্রবণতা-সমাজ ও শিক্ষণবিদ্যার প্রগতিশীল আদর্শ প্রকাশ পেল যাতে, শিক্ষক সমাজের অগ্রণী অংশটি ছিল তার মুখপাত্র।

        লেনিন একাধিকবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, সংস্কৃতি গড়ে তোলা সফল হতে পারে কেবল বৈপ্লবিক নূতনত্বের সঙ্গে অতীতের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের মিলনের ভিত্তিতে।

          জনশিক্ষার ক্ষেত্রে নভেম্বর বিপ্লব মানব ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সুবিশাল দায়িত্ব হাজির করে-তা হল চূড়ান্তরূপে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠায় সক্ষম এমন এক প্রজন্ম গড়ে তোলা।

        যুব কমিউনিষ্ট লীগের তৃতীয় কংগ্রেসের বক্তৃতায় লেনিন বলেন যে, শিক্ষাদান, সংগঠন ও মানুষ করে তোলার কাজটাকে আমূল পুনর্গঠিত করেই কেবল আমরা এইটে নিশ্চিত করতে পারি যে, তরুণ প্রজন্মের প্রচেষ্টার ফল হবে এমন সমাজের নির্মাণ যা সাবেকি  সমাজের মতো হবে না-অর্থাৎ কমিউনিষ্ট সমাজের নির্মাণ।

        পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন করল যে দেশটা সেখানকার গুরুতর শ্রেণি সংগ্রাম, জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সুকঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেও শিক্ষা ও স্কুলের প্রশ্নে অনেক আয়াস ও মনোযোগ অর্পণের মতো সময় ও তৎপরতার অভাব লেনিনের হয় নি।

        লেনিনের উদ্যোগ ও তাঁর পরিচালনায় রচিত হয় স্কুল সম্পর্কে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রথম দিককার ডিক্রিগুলো। সুনির্দিষ্ট  হয় তরুণ প্রজন্মকে মানুষ করে তোলার মূল কর্তব্যগুলো। রুশ বিপ্লবের প্রথমদিকের বছরগুলোয় জনশিক্ষা প্রসঙ্গে সবকটি রুশ কংগ্রেসেই ভাষণ দেন তিনি।

        স্কুলের ক্ষেত্রে বিপ্লবী সোভিয়েত সরকারের প্রথম একটি ব্যবস্থা হল রাষ্ট্র থেকে গির্জা ও গির্জা থেকে স্কুলকে পৃথক করার জন্য লেনিন স্বাক্ষরিত জনকমিসার পরিষদের ডিক্রি (২১শে জানুয়ারি, ১৯১৮)। গির্জার প্যারিস স্কুল ও আধ্যাত্মিক সংস্থাধীন অন্যান্য শিক্ষালয়কে পুনর্গঠিত করা হয় সাধারণ শিক্ষার স্কুল হিসেবে।  যেখানে একত্রে পাঠ নেবে ছেলেমেয়েরা। নতুন ব্যবস্থা চালু হওয়ায় সাক্ষরতা বিস্তার অনেক সহজ হয়।

      প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোর সমস্ত পরিচালন ভার তুলে দেওয়া হয় শ্রমিক-কৃষক প্রতিনিধিদের স্থানীয় সোভিয়েতগুলোর হাতে।

          সোভিয়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার  প্রথম মাসগুলো থেকেই জনসাধারণের মধ্যে নিরক্ষরতা লোপের জন্য গৃহীত হয় উদ্যোগী নানা ব্যবস্থা। ভূতপূর্ব রুশ সাম্রাজ্যের অধিকাংশ লোকই পড়তেও পারত না, লিখতেও জানত না। ১৮৯৭ সালের আদমসুমারি অনুসারে ৯ ও তদূর্ধ্ব বয়সের অধিবাসীদের মধ্যে সাক্ষর ছিল মাত্র ২৪ শতাংশ।

       ১৯১৮ সাল থেকেই গড়া শুরু হয় নিরক্ষরতা দূরীকরণের স্কুল। ১৯১৯ সালের ২৬শে ডিসেম্বর জারি হয় জনকমিসার পরিষদের একটা ডিক্রি, যাতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রের লেখাপড়া না জানা  ৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সমস্ত অধিবাসীদের পক্ষে সাক্ষরতা অর্জন বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯২০ সালের  ২৯শে জুন  জনশিক্ষা কমিসারিয়েতের অধীনে গঠিত হয় নিরক্ষরতা দূরীকরণের সারা রুশ জরুরি কমিশন।

       ১৯১৮ সালের ১৬ই অক্টোবর সারা রুশ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে পাশ হয়  সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রের জন্য সমরূপ শ্রম বিদ্যালয়ের প্রস্তাব। একই সময়ে শিক্ষার রাষ্ট্রীয় কমিশন প্রকাশ করে ‘সমরূপ শ্রম বিদ্যালয়ের মূলনীতি’ (সমরূপ শ্রম বিদ্যালয় প্রসঙ্গে ঘোষণা)। যে পন্ডিতিপনা এবং ছাঁচে ঢালা ও আনুষ্ঠানিকতা ছিল সাবেকি স্কুলের মজ্জাগত, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই চমৎকার দলিলগুলো বিপুল বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণ করে। ‘প্রস্তাব’ ও ‘ঘোষণা’য় জারি হয় নতুন স্কুলের পরিপূর্ণ ইহলৌকিকতা ও সমরূপিতা, বিদ্যার্থীর ব্যক্তিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা, ছেলেমেয়েদের আত্মশাসনের ব্যাপক অধিকার,  গণতান্ত্রিকতা, বিদ্যার সাধারণ শিক্ষামূলক ও পলিটেকনিক্যাল চরিত্র। সমস্ত পর্যায়েই শিক্ষা হয় অবৈতনিক। প্রবর্তিত হয় সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রের অধিবাসী সমস্ত জাতিসত্তার জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষাদান।

        নিরক্ষরতা বিলোপ ও বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার জন্য সোভিয়েত রাষ্ট্র যে সমস্ত ব্যবস্থা নেয়, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে দাঁড়ায় ষোলো আনা সাক্ষরতার দেশ। সোভিয়েত স্কুল গড়ে তোলায় শিক্ষক সমাজের বিপুল ভূমিকার ওপর লেনিন বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী শিক্ষকদের প্রথম কংগ্রেসের বক্তৃতায় বলেছিলেন, শিক্ষক বাহিনীকে নিতে হবে বিপুল শিক্ষামূলক দায়িত্ব। সর্বাগ্রে তাদের হতে হবে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাদানের প্রধান বাহিনী।

         লেনিনের তথা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্রের এই সমস্ত পদক্ষেপের ফলেই পরবর্তী ৫০ বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই সোভিয়েত দেশে গড়ে উঠেছিল বিশ্বের সবচাইতে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক একটি জনশিক্ষা ব্যবস্থা। জনশিক্ষার মুল ধাপটা ছিল সাধারণ শিক্ষার স্কুল, সাত বছর বয়স হলেই সমস্ত  ছেলেমেয়েদের ভর্তি হতে হত তাতে। কোনো না কোনো কারণে যারা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারত না, তাদের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল বয়স্কদের সান্ধ্য স্কুল। উৎপাদনের কাজে যুক্ত থেকেই শ্রমিক ও যৌথ খামারিরা এখানে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করতে পারত।

        বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় স্কুলের অরাজনৈতিকতা নিয়ে একটা অভিমতের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া শিক্ষণবিদরা তা প্রাণপণে শিক্ষক সমাজের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইত। ওই অভিমতের স্বরূপ উদঘাটন করে লেনিন ১৯১৮ সালের আগষ্টে শিক্ষা কংগ্রেসে বলেন, ‘—কোনো বুর্জোয়া রাষ্ট্র যতই বেশি সংস্কৃতিসম্পন্ন, সেটা ততই বেশি কুশলী মিথ্যাভাষণ করেছে যে, বিদ্যালয়গুলো রাজনীতির উর্ধ্বে থাকতে পারে এবং সমগ্রভাবে সমাজের সেবা করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যালয়গুলোকে বুর্জোয়াদের শ্রেণিগত শাসনের নিছক হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল।’ এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য সেই মার্কসবাদী ব্যাখ্যা যে, অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি বা কাঠামো আর শিক্ষা-সংস্কৃতি হল উপরিকাঠামো। যখন যে শ্রেণি রাষ্ট্র পরিচালনার ভূমিকায় থাকে, তারা তাদের মতো করে উপরিকাঠামোকে বিন্যস্ত করে।

        সেই সময় স্কুল  ও শিক্ষকসমাজের জন্য অবিরাম যত্ন নেয় বলশেভিক পার্টি ও সরকার। লেনিন লেখেন, ‘আমাদের এখানে জনশিক্ষকদের  এমন উঁচুতে তুলতে হবে যেখানে বুর্জোয়া সমাজে তারা কখনো ওঠে নি ও ওঠে না এবং উঠতে পারে না।’

       এই ধারা বেয়েই ১৯৬১ সালের ৩১শে অক্টোবর সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির বাইশতম কংগ্রেসে গৃহীত পার্টির কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলক সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যকর করার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

          জনশিক্ষার পুরনো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজে ও সকল রকম বাধা বিঘ্ন দূর করায় সোভিয়েত শিক্ষণবিদ্যার ভূমিকা বিরাট। এই শিক্ষণবিদ্যার পদ্ধতি-প্রকরণের ভিত্তি হল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্ব। বিশ্বের ও স্বদেশের প্রগতিশীল শিক্ষণবিদ্যার অগ্রণী মুখপাত্ররা যে অতি সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তাই নিয়েই সোভিয়েত শিক্ষণবিদ্যার যাত্রা।

       এই নতুন শিক্ষণবিদ্যায় বিপুল অবদান যোগ করেছেন বিশিষ্ট সোভিয়েত শিক্ষণবিদ, কমিউনিষ্ট পার্টি ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের স্বনামখ্যাত নায়িকা, লেনিনের স্ত্রী ও বিশ্বস্ত সহকর্মিণী এন কে ক্রুপস্কায়া, এ এস মাকারেঙ্কো সহ অন্যান্যরা।

         নিবন্ধের ইতি টানব মহামতি লেনিনের সেই বিখ্যাত বাক্যবন্ধের উল্লেখ করে- “There can be no socialism without mass education.”

বি দ্রঃ আমাদের দেশের সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০কে হাতিয়ার করে শিক্ষার অধিকার সঙ্কুচিত করার অপচেষ্টা কিম্বা রাজ্যের সরকারের বহুমুখী প্রচেষ্টায় শিক্ষার অন্তর্জলি যাত্রা নিশ্চিত করার অপকর্ম কতশত যোজন পার্থক্য সূচিত করছে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার থেকে তা  চোখে ঠুলি পরা আমাদের কাছে যত পরিষ্কার হয় তত মঙ্গল।