প্রবাদপ্রতিম রুশ কবি ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভস্কির জন্ম ১৮৯৩ সালের ১৯ জুলাই। কবিতা, নাটক রচনা এবং মঞ্চ ও সিনেমায় অভিনয়-সহ শিল্পের নানা ক্ষেত্রে বিচরণ ছিল তাঁর। প্রথমে তিনি একজন শিল্পী হতে চলেছেন এবং এমনকি চিত্রকলাও অধ্যয়ন করেছিলেন। আভান্ট-গার্ড শিল্পীদের সাথে দেখা করার পরে কবির খ্যাতি তার কাছে এসেছিল, যখন তরুণ লেখকের প্রথম কাজগুলি ডেভিড বার্লিউক দ্বারা উত্সাহের সাথে স্বাগত জানানো হয়েছিল। ভবিষ্যত গোষ্ঠী, “আজকের লুবোক”, “লেফট ফ্রন্ট অফ আর্টস”, বিজ্ঞাপন “রোস্টা উইন্ডোজ” – ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি অনেক সৃজনশীল সমিতিতে কাজ করেছেন।

১৯১৭ সালের আগে অর্থাৎ প্রাক-রুশ বিপ্লবের বছরগুলোতে মায়াকোভস্কি দ্রুত পরিচিত হয়ে ‍উঠছিলেন রুশ ফিউচারিস্ট আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে। তিনি কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন, সিনেমায় নেমেছেন এবং রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে নানা জ্বলজ্যান্ত পোস্টার ছেপেছেন।

১৯৩০ সালে, ১৪ এপ্রিল মায়াকোভস্কি আত্মহত্যা করেন। স্ট্যালিন যুগে কবির অনেক বিরূপ সমালোচনা হলেও মৃত্যুর পর স্ট্যালিন নিজে কবিকে ‘আমাদের সোভিয়েত যুগের শ্রেষ্ঠতম এবং সবচেয়ে প্রতিভাসম্পন্ন কবি’ হিসেবে স্বীকার করেন ।

তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত জর্জিয়ার বাঘদাতিতে এক স্থানীয় ফরেস্টার ভ্লাদিমির কনস্তান্তিনোভিচ মায়াকোভস্কির ঘরে কবির জন্ম। তাঁর মা আলেক্সান্দ্রা আলেক্সিয়েভনা ছিলেন গৃহবধূ। কবির ছিল দু’জন বোন- ওলগা এবং ল্যুদমিলা। নিজের সম্পর্কে ১৯২৭ সালে প্রাগের এক সংবাদপত্রকে বলেন তিনটি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে আমি বেড়ে উঠেছি। বাবার দিক থেকে রুশ এবং জাপোরজীয় কসাক আর মা’র দিক থেকে ইউক্রনীয়, পরিবারের কথা হতো রুশ ভাষায়। স্কুলে বন্ধুদের সাথে কবিকে বলতে হতো জর্জিয় ভাষা। জন্মভূমি জর্জিয়া আদম ও ঈভের মিলনক্ষেত্র সে পুরাণের স্বর্গোদ্যান বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

১৯০২ সাল, ১৪ বছর বয়স থেকেই মায়াকোভস্কি ছোট্ট শহর কুতায়িসিতে নানা সমাজতন্ত্রী বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতেন। মায়াকোভস্কির পড়শিরা তাঁর মা’কে ‘এতটুকু ছেলেকে এত স্বাধীনতা দেবা’র প্রশ্নে অনুযোগ করলেও তাঁর মা মনে করতেন শিশু-কিশোরের বিকাশে খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ না চাপানো ভাল। সেবছর হঠাৎ বিষক্রিয়ায় পিতার মৃত্যু হলে কিশোর কবি তার মা এবং দু’ বোনের সাথে মস্কোতে চলে আসেন। তার আগে স্থাবর সব সম্পত্তি তাদের বিক্রি করে দিতে হয়।

১৯০৬ সাল নাগাদ মায়াকোভস্কি মার্ক্সিস্ট সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ বোধ করতে থাকেন। ১৯২০ সালে লেখা আত্মজীবনী থেকে জানা যায় ‘গল্প-উপন্যাস নয় বরং হেগেল, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং নিশ্চিতভাবে মার্ক্সবাদ পড়তে তাঁর বেশি ভাল লাগতো। লেখা আত্মজীবনীতে একথা বলেন- আমার জন্য মার্ক্সের ‘প্রারম্ভিক’-এর চেয়ে উচ্চতর কোন শিল্প থাকতে পারে না,’।

১৯০৭ সালে যে জিমনাসিয়ামের ছাত্র ছিলেন, সেখানে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের গোপন পাঠচক্রের সদস্য হন এবং অংশ নেন রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির নানা কাজে। স্ট্রগানোভের এক স্কুলে পড়াশুনা করার সময়,তরুণ বলশেভিক এ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে মায়াকোভস্কি প্রচারপত্র বিলি করতেন । ১৯০৯ সাল থেকে জেলের নারী রাজনৈতিক বন্দীদের জেল থেকে লুকিয়ে মুক্ত করে অন্যত্র সরিয়ে দেবার কাজে জড়িয়ে পড়েন। ফলে বেশ ক’বার গ্রেপ্তার হন এবং শেষমেশ ১১ মাসের কারাদণ্ড জোটে। মস্কোর ব্যুতিরকা কারাগারে একাকী বন্দীত্ব অবস্থায় কাটানোর সময় তিনি প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন। পরে আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন বন্দীত্ব অবস্থা কাটানোর সময় ‘বিপ্লব এবং কবিতা আমার মাথায় জড়িয়ে যায় এবং একাকার হয়ে যায়,’ ।

১৯১০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ছাড়া পান। জেলখানায় থাকা অবস্থায় যে নোটবুকে কবিতা লিখতেন, সেটি এক কারারক্ষী নিয়ে নেবার পর জীবনের প্রথম কবিতাগুলো তাঁর হারিয়ে যায়। জেলখানা থেকে ছাড়া পাবার পরও মনের ভেতরে গভীরভাবে সমাজতন্ত্রী রয়ে গেলেন।

১৯১১ সালে মায়াকোভস্কি মস্কো শিল্পকলা স্কুলে ভর্তি হলেন। ১৯১১ সালে ডেভিড বারলিয়ুক নামে এক সহপাঠীর সাথে পরিচয় হয়। বারলিয়ুক প্রথম মায়াকোভস্কির কবিতা শুনে তাঁকে ‘প্রতিভাবান কবি’ আখ্যা দেন। পরে দু্’বন্ধুর বন্ধুত্ব ভেঙে গেলেও এবং চলার পথ ভিন্ন হলেও মায়াকোভস্কি গোটা জীবন জুড়ে বারলিয়ুককে ‘আমার অসাধারণ বন্ধু’ অভিধায় অভিহিত করে গেছেন। ‘বারলিয়ুক আমাকে কবি করে তুলেছিল। আমাকে সে ফরাসী ও প্রুশিয়ান সাহিত্য থেকে পড়ে শুনিয়েছে। আমাকে নিয়ে গেছে পুস্তকের জগতে। প্রতিদিন আমাকে সে ৫০ কোপেক দিত যেন আমি লিখি এবং ক্ষুধায় না মরি!’

১৯১২ সালের ১৭ নভেম্বর মায়াকোভস্কি প্রথম প্রকাশ্যে কবিতা পড়েন। সে বছর ডিসেম্বরে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতাগুলো যেমন ‘রাত্রি’ এবং ‘সকাল’ রুশ সাহিত্যের ফিউচারিস্ট আন্দোলনের মুখপত্র ‘জনরুচির মুখে চড়’-এ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে মায়াকোভস্কির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমি’ প্রকাশিত হয়। ডিসেম্বর ১৯১৩ নাগাদ মায়াকোভস্কি ফিউচারিস্ট আন্দোলনের কিছু সহযোদ্ধাকে নিয়ে সেভাস্তপল, কেরচ, ওদেসা এবং কিশিনেভ-সহ রাশিয়ার প্রায় ১৭টি শহরে ঘোরেন। ১৯১৪ সালের ১৩ এপ্রিল এ ভ্রমণ শেষ হলো বটে তবে ততদিনে কবি এবং কবির বন্ধু বারলিয়ুক দু’জনে মস্কোর শিল্পকলা স্কুল থেকে বহিষ্কৃত। ১৯১৪ সালে লটারিতে ৬৫ রুবল জিতে মায়াকোভস্কি পেট্রোগ্রাডের কাছে কুয়োক্কালা নামে জায়গায় যান। সেখানে তিনি ‘ট্রাউজার পরা মেঘ’ কবিতা শেষ করেন, কোর্নি চুকোভস্কির গ্রামের বাড়ি কয়েকবার বেড়াতে যান, নামী চিত্রশিল্পী রেপিনের মডেল হন এবং প্রথমবারের মত ম্যাক্সিম গোর্কির সাথে সামনা সামনি পরিচিত হন। প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে মায়াকোভস্কি স্বেচ্ছাসেবী হলেও ‘রাজনৈতিকভাবে তার ওপর যথেষ্ট ভরসা করা যায় না’ এ কারণে বাতিল হলেন। এসময় তিনি দেশপ্রেমিক ‘লুবক’-এ এবং নভ (কুমারী মৃত্তিকা)-এ বেশ কিছু যুদ্ধবিরোধী কবিতা যেমন ‘মা এবং একটি সন্ধ্যা যা জার্মানদের হাতে নিহত’ বা ‘যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে’ কি ‘আমি এবং নেপোলিয়ন’র মত কবিতাগুলো প্রকাশ করতে থাকেন। ম্যাক্সিম গোর্কি নিজে লেতোপিস নামে তাঁর জার্নালে মায়াকোভস্কিকে লিখতে বলেন। সে বছরের জুনে মায়াকোভস্কি লিলিয়া ব্রিক নামে এক বিবাহিতা নারীর প্রেমে পড়েন। লিলিয়ার স্বামী ওসিপ স্ত্রীর প্রেম নিয়ে মোটে চিন্তিত হননি; বরং তিনি কবির কিছু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং ফিউচারিস্ট আন্দোলনকে সাহায্য করতে উদ্যোক্তা হিসেবে কিছু চিঠি লেখেন। লিলিয়ার সাথে প্রেম, প্রথম মহাযুদ্ধ এবং সমাজতন্ত্র কবির অদ্যাবধি সেরা হিসেবে স্বীকৃত কাজগুলো যেমন ট্রাউজার পরা মেঘ (১৯১৫), শিরদাঁড়া বাঁশী (১৯১৫), যুদ্ধ এবং পৃথিবী (১৯১৬), ‘শিরদাঁড়া বাঁশী’ বা ব্যাকবোন ফ্লুট (১৯১৬) এবং মানব (১৯১৮)-এ গভীর প্রভাব রাখে। গোর্কির সাহায্যে পের্ট্রোগ্রাড সামরিক গাড়ি চালনা স্কুলে ড্রাফটসম্যানের চাকরি নিলেন এবং সেখানে ১৯১৭-এর শুরু অবধি কাজ করলেন। ১৯১৬ সালে গোর্কির সহায়তায় পারুস (পাল) প্রকাশনা থেকে তাঁর কবিতা সংকলন হাম্বার মত সহজ প্রকাশিত হয়। মায়াকোভস্কি বলশেভিক বিপ্লবকে মনেপ্রাণে আলিঙ্গন করে কিছুদিন স্মোলনিতে কাজ করেন যেখানে তিনি ভ্লাদিমির লেনিনকে অন্য বিপ্লবী সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মেলাতে দেখেন। সে অনুভূতির বিবরণ দেন আত্মজীবনীতে এভাবে: ‘গ্রহণ করা বা না করা, এমন কোন প্রশ্ন ছিল না…সেটা ছিল আমার বিপ্লব।’ ১৯১৭-এর নভেম্বরে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক আয়োজিত লেখক, চিত্রশিল্পী এবং নাট্য নির্দেশকদের এক সভায় নয়া শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেবার সভায় মায়াকোভস্কি অংশ নেন।

১৯১৮ সালে মায়াকোভস্কি নেপচুন স্টুডিও নির্মিত তিনটি নিঃশব্দ সিনেমায় অভিনয় করেন যাদের চিত্রনাট্য তাঁর লেখা। ১৯২২-এর মে মাসে মায়াকোভস্কি পভোলঝেয়ে দূর্ভিক্ষের পীড়িত মানুষের জন্য চাঁদা তোলার কাজ শেষ করে চলে যান বিদেশ বেড়াতে। ঘুরে দেখেন রিগা, বার্লিন আর প্যারিস। প্যারিসে তিনি পিকাসোর স্টুডিওগুলো ঘুরে দেখেন। ১৯২২ থেকে ১৯২৮ নাগাদ মায়াকোভস্কি Left Art Front এর সদস্য ছিলেন যাদের শ্লোগান ছিল ‘ঘটনার সাহিত্য, কল্পনার নয় (literature of fact, not fiction)।’ অক্টোবর ১৯২৪-এ মায়াকোভস্কি ভ্লাদিমির উলিয়ানভ লেনিনের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর মহাকাব্যিক ৩,০০০ পঙক্তির কবিতাটি অসংখ্য জনসমাগমে পড়ে শোনান। পরের ফেব্রুয়ারিতে এ কবিতাটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। পাঁচ বছর পর মায়াকোভস্কি এ কবিতার তৃতীয় অংশটি যখন বলশয় থিয়েটারে পড়ে শোনান, ২০ মিনিট ধরে শ্রোতারা তাঁকে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিবাদন যোগান। ১৯২৫ সালে কবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং কিউবায় ভ্রমণ করেন। জানুয়ারি ১৯২৭-এ Left Art Front ((LEF)-এর প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়। ১৯২৯ সালে প্রকাশনা সংস্থা গসলিতিজিদাজ চার খণ্ডে ‘মায়াকোভস্কি রচনা সমগ্র’ প্রকাশ করেন।

১২ এপ্রিল ১৯৩০-এ মায়াকোভস্কিকে শেষবারের মত জনসমাবেশে দেখা যায়। ১৯৩০ সালের ১৭ এপ্রিল মায়াকোভস্কির শেষযাত্রায় দেড় লক্ষ মানুষ অংশ নেন। লেনিন এবং স্ট্যালিনের শবযাত্রার পর এটি রাশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শেষযাত্রা। পক্ষ-বিপক্ষের নানা মতামতের পর মায়াকোভস্কিকে ‘রুশ কবিতার ক্রুদ্ধ ষাঁঢ়,’ ‘ছন্দের যাদুকর’ এবং ‘প্রচলিত রুচিবোধ ও প্রমিত মানের বিপরীতে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী ও বিদ্রোহী’ হিসেবে আজ মনে করা হয়।