ক্ষীণ আশা ছিল ভবিষ্যতে নরেন মোদী সৎ হতে পারেন। দুর্নীতির তদন্ত হবে। ১১৭৫ দিন পরে হতভাগ্যরা জেনেছেন মোদীর জানাজার গল্প। মমতা জিতেছেন, বাংলার মেধা পরাজিত শেখ শাহজাহানদের কাছে। আন্দোলনের ঊষর ভূমিতে দীর্ঘশ্বাস বইছে। এসএসসির শিকারের তিনটি অংশ (ক) যোগ্য, (খ) অযোগ্য এবং (গ) অযোগ্যরা যে যোগ্যদের চাকরি চুরি করেছে। গত ছয় বছর, যোগ্য এবং অযোগ্যরা (ক ও খ) ইস্কুলে পড়াতে গেছে আর চাকরি চুরি যাওয়া যোগ্য প্রার্থীরা (গ) ধর্মতলায় বাপুর চরণে আশ্রয় খুঁজেছেন। গুজরাতি প্রধানমন্ত্রী মোদী ধনপ্রাপ্তির মোহে সেটিং বন্ধনে নিবিড় ছিলেন। অবর্ণনীয় কষ্টকর দিনাতিপাত হতভাগ্যদের। রাজ্য সরকার, পুলিশ প্রশাসন, মাসোহারার সুশীল সমাজ স্বীয় স্বার্থে চুড়ান্ত অমানবিক। স্রেফ হাওয়াই চটি ভালবেসে বহু মানুষ অনৈতিক নির্যাতনকে নীরবে সমর্থন দিয়েছে। কীসের বিনিময়ে? কেন দুর্নীতিতে নিরুত্তাপ? কোন মহিলার সন্তান হয়ত ষাট গুণ বেশী মায়না পেতে পারত। হিটলারের নাৎসী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মত পাশবিক পথের পাঁচালীর দিবসগুলি। নগরজীবন যথারীতি উদাসীন।

পুরুষ ও মহিলা আন্দোলনকারীদের পথে অবস্হানের সময়ে রাতে সুলভ শৌচালয়গুলিতে তালা দিয়েছে পুলিশ। সেই দানব পুলিশ ডিউটি শেষ করে মুখ ধুয়ে মানুষ সেজে পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছে। যদি সেটিংপ্রিয় ধর্ম ব্যবসায়ী না হন, চোর না হন, আলাঘরের ধর্ষক বা পুলিশ-প্রশাসক-সুশীল না হন, তাহলে ভাবুন। পরবর্তী শুনানি ১৬ই জুলাই। সেখানে দুটি পক্ষ। মোট চাকরি প্রাপক ২৫,৭৫৩ জনের মধ্যে সিবিআই ৮,৩২৪ জনকে অবৈধ দাবী করছে। বাকিরা যে বৈধ, চাপে পড়ে তেমন সাক্ষ্য প্রমাণ শীর্ষ আদালতে হাজির করার সম্ভাবনার ভরসা দিয়েছেন এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। প্রাপকদের বৈধতা প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণ করতে পারলে যোগ্যদের চাকরি বহাল ও অবৈধ নিয়োগ খারিজ হবার রায়ের সম্ভাবনা প্রবল। দ্বিতীয়তঃ অবৈধ নিয়োগ কি সত্যি ৮,৩২৪ জন, নাকি বেশী? মোদী নিয়ন্ত্রিত সিবিআই তদন্তের উপর ভরসা কম। দুর্নীতির প্রকৃত আকার ও আয়তন গোপন করতে মোদী ও মমতা সরকার, সংসদ হয়ত বৈধ-অবৈধকে আলাদা করতে চাইবে না। মোদীর বিসর্জনে সম্ভাবনা প্রবলতর হল।

যাদের চাকরি চুরি হল এবং দীর্ঘ দিন যারা পথে বসে আন্দোলন করলেন, তাদের কী হবে? সরকার বা সংসদ যদি অযোগ্য ও যোগ্যদের চিহ্নিত না করে, তবে পুরো প্রক্রিয়াটা ঢাকী সমেত বিসর্জন হয়ে যাবে। যারা চাকরি করে মায়না পেয়েছে এবং যারা বিনা বেতনে রোদ জল ঝড়ে ফুটপাথে আন্দোলনে ছিল সবার অনাকাঙ্খিত বিসর্জন ভবিতব্য। অবৈধরা মায়না ফেরৎ দিলেও সবচেয়ে হতভাগা পথে বসে থাকা চাকরি চুরি যাওয়া যৌবন। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গলন্ত পিচ রাস্তায় গড়িয়েছে, শুয়ে পড়েছে, চুল কেটেছে, অনশন মঞ্চেই পূজো পার্বনের অভিনয় করেছে। ভাতাভোগী মধ্যযুগীয় জনতার সহানুভূতি পায়নি। ওনারা যে পারবেন না, ২০১৮ সালেই ধারণা হয়েছিল। আশঙ্কা অমূলক হলে খুশী হতাম। ওনারা ‘মানুষে’র সহানুভুতি চেয়েছেন। যদি ‘মানুষ’ না থাকে, তবে আন্দোলনের গতি প্রকৃতি ভিন্নতর হওয়া উচিৎ ছিল। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কি আপনাদের মানুষের পর্যায়ে বলে মনে হয়? এসএসকেএমে কুকুরের ডায়ালিসিস হয় বলেই কি সর্বত্র পশুর ওষুধে মানুষের চিকিৎসা হবে? মোদী ভাল হবেন? ভাবনাটা ভুল।

২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের কাছে উপদেশ ছিল, মুখ থেকে ‘মান্নিয়া’ শব্দটাকে উপড়ে না ফেললে দুর্নীতি উৎপাটন সম্ভব নয়। দীর্ঘ ব্যবহারে হীনমন্যতা এমন ভাবে রক্তে মিশে গেছে যে চিতায় শুয়েও হয়ত আন্দোলনকারী হাত তুলে বলে যাবেন, মান্নিয়া, বিদায়! আপনি যদি মান্নিয়া বলেন, তাহলে চেয়ারে বসা গণশত্রুকে প্রয়োজনের বেশী অযথা গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন। যে কোন যুদ্ধে প্রথম কাজ শত্রুকে নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা, বলবত্তা নির্ণয় এবং শত্রুর অনৈতিক কর্মপদ্ধতির প্রতিষেধক আবিষ্কার করা। আপনার চাকরি চুরি হয়েছে। সেই চুরি যাওয়া চাকরি এজেন্টরা গড়ে দশ লাখ টাকায় বিক্রী করেছে। এজেন্টরা হাঙরের নেতৃত্বে সংগঠিত শক্তি। একটি করালগ্রাসী অগ্নিগহ্বর আছে, যাঁর অঙ্গুলিহেলন বিনা গাছের পাতা নড়তে পারে না। সেই শক্তিতে আপনি যদি গুরুত্ব দেন, তাহলে আপনিও মোদীর মত শত্রুর সাথে আপোস করে ফেলেছেন। শত্রু আপনাকে বিলক্ষণ চেনেন। আপনাদের চোখের জলে ডুব দিয়ে কিছু মীরজাফরকে আপনার পাশ থেকে তুলে নিয়েছে পার্থবাবুরা। আপনি তখন মান্নিয়া ভজনায় ভীত সন্ত্রস্ত।

মীরজাফরদের দায়িত্ব ছিল, কোন রাজনৈতিক শক্তি আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালে প্রতিবাদে চিৎকার করে বলে ওঠা- প্লিজ কোন রাজনীতি আনবেন না। রাজনীতির নীতি, আদর্শ ও পথ থাকে। নীতিহীনতায় কোন বন্দরে এই জাহাজকে নোঙর করতে দেওয়া যাবে না। কিছু গণসংগঠন, দরদী এগিয়ে এসেছিলেন। পার্থবাবুদের দালাল মীরজাফররা অরাজনৈতিক গন্ডী টেনে প্রতিহত করে রাতের অঁধারে পার্থবাবুর সাথে মন্ত্রণায় বসেছে। ৮,৩২৪ জনের তালিকায় অভিযুক্ত মীরজাফররাও আছে। মনে করুন, জনৈকের নাম ইনসান আলি। ছেলেটি অযোগ্য ছিল না, কিন্তু লোভ, লালসা ও বিশ্বাসঘাতকতা ঘৃণার সরণীতে সর্বশান্ত। ইনসান আলিরাই বলেছে, আন্দোলনকারীদের সামনে উপযুক্ত গাজর না ঝোলালে ওদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের কথা একদিন সারা বিশ্ব জেনে যাবে এবং সরকারী মমত্বের কঙ্কালে চূণকালি পড়বে। এই আন্দোলন বুকের গভীরতম যন্ত্রণার। উন্মত্ত চাকরি চোররা যে খবর রাখত না, কিন্তু ইনসানরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ক্যাবিনেটে খুড়োরা বসে পড়েছে। সুপার নিউমারারির যাদুতন্ত্র উন্মোচিত হয়েছে নতুন হাতিয়ার।

বর্তমানে সুপার নিউমারারির চতুর খুড়োরা সিবিআই তদন্তের মুখে। আদালতে হাত জোড় করে অনুনয় করছে, নির্বাচনের প্রাক্কালে যেন কোন মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার না করা হয়। ভোটের আগের মোদী সরকার নীরব ছিলেন। যোগ্যদের ঠকাবার উপযুক্ত শাস্তি পেলেন বৃদ্ধ অধার্মিক সেটিংবাজ কিন্তু আন্দোলনকারীরা সুফল পেলেন না। ফলে আন্দোলনের ১১৭৫তম দিনে তাঁরা হতাশাগ্রস্ত। যে যোগ্যরা চাকরিতে যোগদান করেছে, যে অযোগ্যরা ঘোমটা পরে নীরব মোদী হয়ে ইস্কুলে পড়াতে ঢুকে গেছে, তারা কেউ আন্দোলন করেনি। আন্দোলনকারীদের পাশেও থাকেনি। আন্দোলনের সূত্রপাত যাদের চাকরি চুরি গেছে, তারাই করেছেন। তত দিনে বঙ্গে গোঁফ থেকে চাকরি চুরি যাওয়ার সংস্কৃতি রাজনৈতিক পালাবদলের পর সবাই জানেন। চোরও চিহ্নিত। আন্দোলনও দীর্ঘ দিনের। প্রতিরোধকারীরা প্রকাশ্যে। তবু চোরকে আঙুল তুলে চোর বলতে না পারার খেসারত দিল আন্দোলন। আন্দোলনের ব্যর্থতার দিকগুলি চিহ্নিত করতে পারলে আগামী দিনের প্রতিবাদীরা শিখবে। পথে পুলিশের লাঠি সহ্য করেও নেতৃত্বের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আন্দোলন।

অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারী লুম্পেনরা সরাসরি আক্রমণ করে, খুন-ধর্ষণ করে, জন সমর্থন হারাবার ভয়ে তেমনটা করতে পারেনি বর্বররা। অভব্যতা করেছে পুলিশ, পুলিশের পোষাক পরা দুষ্কৃতিরা। পুলিশ যেমন অমানবিক তেমনই অনেক বামপন্হী আইনজীবী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। যাঁরা মোমের মত পুড়ে, রক্তাক্ত হয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন প্রতারকদের তাঁরা সমাজবন্ধু। প্রত্যয়ের অভাবে যা শোকগাঁথা, তাই হতে পারত বিশ্ব ইতিহাসে বিরল সাফল্য। যে শত্রু রাজনীতির পাশায় আপনাকে পরাজিত করে সর্বস্ব লুন্ঠন করেছে, তাদের বলেছন, দ্যূতক্রীড়া জানি না। রাজনীতির জবাব রাজনীতিতেই দিতে হয়। সে কথা যেমন পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানতেন, তেমনই জানত ইনসান আলিরা। ওরা গোপনে সওদা করতে গিয়ে যেমন ফেঁসেছে, ঠিক তেমনই এই আন্দোলনের প্রত্যাঘাতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত বীরশ্রেষ্ঠ তৃণমূলী তরুণী বান্ধবী সহ কারাগারে বন্দী। গোপন সেটিংবাজ মোদীও ভাবতে পারেননি, জনতা জবরদস্ত শিক্ষা দিয়ে দেবে। আজ আন্দোলন স্হল ফাঁকা রাজনৈতিক ফলাফলের কারণে। গ্ল্যাডিয়েটররা হয় বধ্য, নয়ত ঘাতক।

যদি সামনে দুর্জনের তরবারি থাকে, তাহলে ঘাতক হওয়াই আপনার ধর্ম। সেটাই ইনসাফ, ইনসান আলি ভুল পথে চালনা করবে। আপনাদের সব ছিল, প্রত্যয়ী দিশা ছিল না রাজনৈতিক অলীক ভীতিতে। শীর্ষ আদালত বৈধ-অবৈধের তালিকা প্রস্তুত করতে পারলে, এবং গাজিয়াবাদ থেকে প্রাপ্ত ডেটাবেস উদ্ধার করে তার বৈধতা দিয়ে পাঠোদ্ধার করলে, যাদের চাকরি চুরি গেছে, তারা সঠিক বিচার পেতে পারেন। যে রাজ্যে ক্যাবিনেট সুপার নিউমারারির মত ঘৃণিত চক্রান্তে অবৈধ চাকরি বাঁচাতে চায়, যে দেশে কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত তদন্ত নিষ্পত্তির জন্য সিবিআইকে চাপ দেয় না, মোদী ভূমিতে ধর্ম মতে বিচার পাওয়া দুঃসাধ্য। এই দানবগুলো কিন্তু রাজনীতির লোক। হয়ত আপনাদের ভোটেই আপনাদের খুনের অধিকার পেয়েছেন। এই লোকগুলোকেই নিধন করা আপনার ধর্ম। প্রত্যয়ী হন। আপনার শোকগাঁথা গাইতে হবে না। আপনারা বহু আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে উঠবেন। শাসক অপরাধ লুকোতে আরো বড় অপরাধ করবে।

নবান্নের রাজনৈতিক দল জানে ৮,৩২৪ না কত অবৈধ নিয়োগ ছিল। সুপ্রিম কোর্ট প্রাথমিক অবজার্ভেশনে বলেছে, এটি একটি সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত অপরাধ। অবৈধদের থেকে এজেন্ট মারফত নগদ টাকা তুলেছে। সারা বাংলা জুড়ে সেই বঞ্চিত অপরাধীরা এজেন্টদের বাড়িতে হামলা করুক, কোন রাজনৈতিক দল বা সরকার নিশ্চই চায় না। পীড়নে কলরব বেশী হবে। ফলে খানিক দমন, খানিক অন্যত্র অবৈধ কর্ম সংস্হানের ব্যবস্হা করে দেবে সেই রাজনৈতিক দল, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার। ওরা আবার আপনার বুকের উপর মাড়িয়ে চাকরিতে যাবে। আপনার মায়ের ভাবনা ছিল, তিনি মেধাবী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। যোগ্যতায় সে চাকরি পাবে। অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে রাখা কোটি কোটি মহিলা আছেন, যাঁদের সন্তান সেই যোগ্যতার পরীক্ষায় নেই। বোম বাঁধার অপেক্ষায় দিন গুজরান করেন। তাঁদের কাছে হাজার টাকার মূল্য আপনার মায়ের স্বপ্নের চেয়ে অনেক দামী। কোন মা মেধাবী সন্তানকে নিরাপদ ভবিষ্যৎ দিতে পারছেন না। যেমন মোদীর বিচার হয়েছে, তেমন সব চোরের বিচার হতে বাধ্য। আপনারা প্রত্যয়ী থাকুন।