শারদ উৎসব শেষ হলো– শহরের দূর্গা প্রতিমা প্রদর্শনীর দ্বারা হুল্লোরপূর্ণ আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে(কার্নিভাল)। জনগণের করের টাকায় আমাপা খরচ করে এই আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করা হয়েছে।গত কয়েকদিন ধরে সারা রাজ্য জুড়ে উৎসবের আলোর রোশনাই, মাইকের কান ফাটানো আওয়াজ, নাচা — গানায় সাধারণ মানুষ যখন আনন্দে উদ্বেলিত , তখন কামদুনির কালো ক্ষত আরও কালো হয়েছে। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে কামদুনি। নিম্ন আদালতের ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামী আমিন আলিকে মুক্তি দিয়েছে হাইকোর্ট, তার সাথে আরও তিনজন মুক্তি পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথে একরাশ ঘৃণা ও অদম্য জেদ নিয়ে কামদুনি লড়ে যাচ্ছে।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই রাজ্যের কর্ণধারদের। তাদের অনুশোচনাও নেই। একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার ষোলজন সরকারী আইনজীবি (পি.পি.) পরিবর্তন হলে সেই মামলার আর কিছু থাকে কি? ২০১৩ সালের ৭ ই জুন রাতে কামদুনিতে উদ্ধার হয় ধর্ষিতা কলেজ পড়ুয়া তরুণীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। যিনি নির্যাতিত হন, তিনিই এর জ্বালা — যন্ত্রণা বোঝেন। সমগ্র দেশ এই ঘটনায় উত্তাল হলো। ১৭ জুন মাননীয়া গেলেন অকুস্থলে। সহানুভূতির পরিবর্তে তিনি মেজাজ হারিয়ে টুম্পা-মৌসুমীকে ‘সিপিএম- নকশাল’ দেগে দিয়ে লম্ফঝম্ফ করে গাড়িতে উঠে চলে এলেন। তখনই আঁচ করা গিয়েছিল এই মামলার ভবিষ্যৎ। পার্কস্ট্রীট কাণ্ডেও সুজেট জর্ডনকে মিথ্যাবাদী ও ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ও কাকলি ঘোষদস্তিদারের কথাটা যে মিথ্যা, তা প্রমাণ করলেন দক্ষ আই.পি.এস. অফিসার দময়ন্তী সেন। তিনি প্রমাণ করলেন সুজেট জর্ডনকে ধর্ষণ করা হয়েছে, এবং এই অপরাধে তিনি তিনজন আসামীকে গ্রেপ্তার করলেন। তারপর বেশিদিন যায়নি, কয়েকদিনের মধ্যেই দময়ন্তী সেনকে বিভাগীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

স্বাভাবিকভাবেই অপরাধীরাও বুঝতে পারলো যে, এখানে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়। একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় ক্রমাগত পি.পি. পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি জানতেন না? সব জেনেও না জানার ভান করে বসেছিলেন। মামলার তদন্তের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁরই তো নজরদারী করার কথা।যেহেতু তিনি শাস্তি হবে, বলে এসেছিলেন।কথা রাখেনি উনি।
বিভিন্ন মামলার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে ,
এইসব গুরুতর মামলার ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১) আই.ও. (ইনভেস্টিগেটিং অফিসার), ২) পি.ও. (প্লেস অব অকারেন্স) ৩) সময় ৪) মেডিকেল ও ফরেনসিক রিপোর্ট ও ৫) প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ও পারিপার্শ্বিক তথ্য।

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে জানা যায়, মেডিকেল রিপোর্টের ৯২ পৃষ্ঠার রায়ে ৮৪ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে আদালতে যে মেডিকেল রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে বর্বরতা সেই তুলনায় নেই। রিপোর্টে ধর্ষিতা কিশোরীর ভ্যাজাইনা, অ্যাবডোমেন এবং পেলভিক অংশে ক্ষতের গভীরতার উল্লেখ নেই। প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থ পুলিশ। তাহলে কি মামলার শুরুতেই ষড়যন্ত্র মাফিক আই.ও.- ঠিক করা, পি.পি- ঠিক করা, চার্জশীট পেশ করা, সাক্ষীদের বয়ান রেকর্ড করার মতো কাজগুলি ঠিকঠাকভাবে করা হয়নি? হাইকোর্টের রায় সেই কথাই বলছে। ভীতি প্রদর্শন করে সত্যকে চেপে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। পোস্টমর্টেম করানোর ক্ষেত্রেও কি কালো হাতের ছায়া ছিল? ঘটনাক্রম কিন্তু সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।। পুলিশের যা কাজ তাই-ই করা উচিত। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা হল পুলিশের অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দেওয়া, নেতাদের পাহারা দেওয়া কিংবা পুজো-পার্বন-খেলা-মেলার ফিতে কাটা। সেই সব সামলে এইসব গুরুতর অপরাধের ঘটনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে পদক্ষেপ করার মতো সময় তাঁদের কোথায়? তাঁদের তো হ্যাণ্ডিক্যাপড করে রেখে দিয়ে দলদাসে পরিণত করার খেলা চলছে প্রতিনিয়ত।

২০১১ এর পরিবর্তনের পর মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রাজত্বে কামদুনির সাথে মিনাখা, মধ্যমগ্রাম, কাটোয়া, লাভপুর- সবাই যখন কাঁদছে, তখন লক্ষীর ভাণ্ডারের টাকায় নতুন করে দুর্গাপুজার পত্তনও হচ্ছে। এ এক গুলিয়ে দেওয়ার রাজনীতি। অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন, আমি গুণ্ডাদের কন্ট্রোল করি, সেই রাজ্যে আর কি আশা করা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, চাকরিচোর,কয়লাচোর,গরু চোর, রেশনের খাদ্য – চোরদের রক্ষার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ফিজ দিয়ে সরকার উকিল রাখতে পারে, আর একজন ধর্ষিতা কিশোরীর জন্য দক্ষ উকিল দিতে পারে না।লজ্জার বিষয় হল, এই রকম স্পর্শকাতর একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলায় ১৬ জন সরকারি উকিল পরিবর্তন হয়ে যায়, এও এক ইতিহাস।কেন বারবার সরকারি উকিল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ,তার কার্যকারন কি ,তাও সরকার কোন সদর্থক পর্য্যালোচনা করেনি।তার জন্যই আজ পশ্চিমবঙ্গের এই হাল হকিকৎ। আসামীরা বেকসুর খালাস হয়ে যাচ্ছে।শাস্তির হার কমে যাচ্ছে।

সংবাদপত্রে পরিবেশিত সংবাদে দেখা যাক এই রাজ্যে ভয়াবহ ধর্ষণের চেহারা:— কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে (শিরোনামে) এবং বিভাগীয় দপ্তরের রিপোর্টে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়ভীতি, নিরাপত্তাহীনতায় মানসিক দুশ্চিন্তায় সমাজ আজ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে । নারী পাচার, নারী নিগ্রহ, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি চরম অবস্থার দিকে যাচ্ছে।

*২৫ অক্টোবর মধ্যমগ্রামে গণধর্ষণ– বাড়ি পাল্টেও শেষ রক্ষা হলো না। এলাকা বদলেও রক্ষা পায়নি ধর্ষিতা কিশোরী।

•* রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে ট্যাক্সিতে গণধর্ষণ।

• প্রেসিডেন্সীতে শ্লীলতাহানী।

• বাসে শ্লীলতাহানি, অভিযুক্ত কণ্ডাক্টর।

• কলেজে ‘অসম্মান’, প্রতিকার না পেয়ে আদালতে শিক্ষিকা।

• পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে আমায় — খুনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে জবানবন্দি।

• শ্লীলতাহানির আতঙ্কের মধ্যেই হামলা কড়েয়ায়।

• টানা হ্যাঁচড়ার ২৪ ঘণ্টা।

প্রকাশিত সংবাদ : একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে ২০১২ তে মোট দুই হাজার চল্লিশ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়ের সংখ্যা ১০৫টি। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী ধর্ষিতার সংখ্যা ১৭৪ জন। এছাড়া সংস্কৃতির রাজধানী বলে গর্ব করা পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের ওপর অত্যাচার, নিগ্রহের মতো ক্রাইমের ঘটনা ঘটেছে ৩০ হাজার ৯৪২টি। গোটা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২৯ শে ডিসেম্বর
বর্তমানের শিরোনাম:– অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে ধর্ষণ। ধৃত চালক। –

আস্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে পশ্চিমবঙ্গ ‘কালো ক্ষত’।

লাভপুরের ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে– ভারতে বেড়ে চলা ধর্ষণ এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা আতঙ্কের পর্যায়ে চলে গেছে বলে বিদেশের সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, সি.এন.এন এইসব সংবাদমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। ‘গার্ডিয়ান’ লিখেছে, “বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ একটি কালো ক্ষত হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

এই কালো ক্ষত আমাদের সমাজ জীবনে যে স্থায়ী অবক্ষয়ের সৃষ্টি করেছে তা আজ ক্রমশ আরো দুরারোগ্য পর্যায়ে চলে যাবার আগেই আমরা কি তা আরো বাড়তে দেবো? এর বিরুদ্ধে সমবেতভাবে গর্জে উঠবো না? প্রতিরোধ আন্দোলন আমাদের করতেই হবে। কামদুনি আজ একা নয়, আমরাও তাদের পাশে আছি, থাকবো তাদের সমব্যথী হয়ে। “(তথ্য সংগৃহীত,) তাং-২৭-১০-২০২৩