দেশে এত বেকার কেন? কেন বেশির ভাগ সক্ষম মানুষের হাতে কাজ নেই? এ সব প্রশ্নের উত্তর কি দেশের, রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের দেওয়ার কথা ছিল না? কর্মসংস্থান কি নির্বাচিত সরকারের সরকার পরিচালনা করার এজেন্ডার বাইরে? কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের শাসন কাল দেখলে বোঝার কোন উপায় নেই যে এই সরকারের অগ্রাধিকার কোনদিন কর্মসংস্থান ছিল।

বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে বলেছিল তারা বছরে ২ কোটি মানুষের চাকরি দেবে।কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা হয়েছে দেশে রেকর্ড বেকারত্ব। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে ১৫-২৯ বছর বয়সের মধ্যে ৪২% যুব বেকার থাকছে; কিন্তু এরকম নয় যে তারা শিক্ষায় বা অন্যত্র রয়েছে। বেকারত্ব বেড়ে চলার এই ধারা কোভিড অতিমারীর আগেই শুরু হয়েছিল।বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সব কথাতেই একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে, কিন্তু দেশের মানুষের বেকারত্ব ঘোচানোর কোন প্রচেষ্টা এই দুই দল করে নি। ২০১৪ সাল থেকে দেশের মানুষের হাতে কাজ নেই। আবার ওদিকে ২০১১ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে মানুষ কাজ হারাতে শুরু করেছে। মানুষের হাতে কাজ কেন নেই সে বিষয়ে দুই সরকারই এক উত্তর দিয়েছে। দুটি দল একইভাবে বলে চলেছে অসত্য তথ্য যে তারা তাদের শাসনকালে কত কর্মসংস্থান হয়েছে , কত কাজ রয়েছে মানুষের হাতে। কোন সরকারী পরিসংখ্যানের তোয়াক্কা না করে সব পরিসংখ্যান দিয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এবং রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ভাষণে। কিন্তু আসলে কেমন আছেন দেশের মানুষ?

দেশে যুবদের মধ্যে বেকারত্ব রেকর্ড ছুঁয়েছে। দেশে শিক্ষিত বেকার রেকর্ড ছুঁয়েছে। ২০২৩ সালে আগস্ট মাসে বেকারত্ব ছিল ৮.১%। কিন্তু মোদীর অসত্যভাষণ আমরা শুনেছি যে বেকারত্ব নাকি ৬ বছরে সবচেয়ে কম হয়েছে এ দেশে।ঠিক তেমনটাই আমরা শুনতে পেলাম এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে যে এ রাজ্যে কাজ পাচ্ছেন ‘উন্নয়নে’র জোয়ারে রাজ্যের মানুষ। দেশের ‘বিকাশ’ এবং রাজ্যের ‘উন্নয়নে’র কথা যাই হোক না কেন তা তো আদৌ মানুষের জীবন জীবিকার লড়াইয়ে কোন সাহায্য করছে না, তা তো মানুষ হারে হারে বুঝছেন।১৫-২৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে অর্থাৎ যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪২%। স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪২%। কৃষিকাজ থেকে যুবসম্প্রদায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কারণ বুঝতে দেশের মানুষের অসুবিধা হচ্ছে না, কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে শাসক দলের। এখনও এ দেশে কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবার এবং মানুষজন বেশি, কিন্তু কৃষির থেকে আয় সব ক্ষেত্রের চেয়ে কম। তাই পরিবারের যুব সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুবকেরা পাড়ি দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে।যে যুবকেরা কাজ করছেন,  কৃষির থেকে অকৃষিকাজে কাজ করছেন কর্মরতা যুবকের ৭০.৮%। এটা ছিল ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান। ২০১৯ সালের পর দ্রুত গতিতে কাজ হারাচ্ছেন মানুষ। এই যুবকেরা আবার ফিরে এসেছেন কৃষিকাজে খেতমজুর হয়ে অথবা নির্মাণ শ্রমিকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। পুরোটাই অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এই যুবকেরা। আর যুবতীরা কেমন আছেন? যারা কাজ করছেন, এমন যুবতীদের মধ্যে অকৃষিকাজে কাজ করছেন কর্মরতার ৪২.৩%। বেশির ভাগ যুবতী আছেন কৃষিকাজে খেতমজুরিতে।

কেমন আছেন মানুষ? এর উত্তর জানেন না শাসক দল বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস। তারা যদি জানতেন মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্কট, তাহলে তাদের প্রাক নির্বাচনী ভাষণে কর্মসংস্থানের কথা তারা বলতেন। তারা দুই দলই বলছে মানুষকে , বেকারদের নানা প্রকল্পের অন্তর্গত করে ভাতা দেওয়ার কথা। ভাতা অন্তর্বর্তীকালীন কর্মসূচী। নির্বাচনের আগে মানুষ জানতে চায় কাজের খোঁজের কথা। কোথায় শে কথা? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সর্বশেষ এক সমীক্ষা এবং প্রাক-নির্বাচনী এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে মানুষ বেকারত্বকে এই নির্বাচনের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা বলে মনে করছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষায় জানা যায় ৩৮.১% উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে তাঁদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতায় কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কমে গেছে দ্রুতহারে গত দশ বছরে।সমীক্ষায় ৭২% মানুষ জানিয়েছেন যে গত দশ বছরে তাঁদের আয় হয় একই রকম আছে, নয় কমে গেছে কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ ৭২% মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এরকম একটি তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত পরিবারের ভোগব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষাতেও উঠে আসছে। পরিবারের ব্যয় কমে গেছে। কারণ বুঝতে কি অসুবিধা হয়? কাজে হারাচ্ছে মানুষ, আয় কমছে মানুষের, জিনিষের দাম বাড়ছে। মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার এই সমস্যাগুলি নেই কেন শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের প্রাক নির্বাচনী বক্তৃতায়? কে দায়িত্ব নেবে মানুষের কর্মসংস্থানের? যে সরকার ভোটের নির্বাচিত, কেন তারা সেই দায়িত্ব নিলেন না , প্রাক নির্বাচনী প্রচারে সেই কথা একবারও শাসক দল বলবে না?

চলছে কি করে কর্মহীন পরিবারগুলি? কিভাবে দিন গুজরান করছে তারা? ২০২২-২৩ সালের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আরেকটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে দেশের পরিবারগুলির মোট আর্থিক সঞ্চয় দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের ৫.১%, যা গত ৪৭ বছরের মধ্যে নিম্নতম! কেন সঞ্চয় করছেন না দেশের বেশির ভাগ পরিবারগুলি? খোঁজ রেখেছেন নির্বাচিত সরকার? কারণ তো একটাই- কাজ নেই, রোজগার নেই। মতিলাল অসয়াল নামে একটি আর্থিক সংস্থার এক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত্য সময়ে দেখা যাচ্ছে যে দেশের পরিবারগুলির মোট সম্মিলিত ঋণের বোঝা মোট জাতীয় উৎপাদনের ৪০.১%! ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে যে এই ঋণের মধ্যে অসুরক্ষিত ঋণ অর্থাৎ মহাজন এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে, ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা থেকে ঋণ ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া সুরক্ষিত ঋণ এবং কৃষিঋণের চেয়ে অনেক বেশি। কত অসহায় দেশের মানুষ এই তথ্য থেকে স্পষ্ট।

দেশের মানুষ আর্থিক ভাবে বিপন্ন, অসহায়-এর একটিই কারণ-কাজ নেই, কাজ না থাকার জন্য আয় নেই। কাজ না থাকার জন্য আয় কমছে শুধু তাই নয়। যারা কাজ করছেন, তাঁদের মজুরিও কমছে। যারা নিয়মিত কাজ করছেন, গত দশ বছরে তাঁদের গড় প্রকৃত মাসিক মজুরি বা আয় হয় একই আছে নয়তো কমে গেছে। একমাত্র ক্যাসুয়াল কাজ যারা করেন, তাঁদের অতি সামান্য মজুরি বেড়েছে গত দশ বছরে; কিন্তু তাঁদের কাজের তো স্থিরতাই নেই।একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে যে অনলাইন পরিষেবায় বেশ কিছু চাকরি হয়েছে। কাজ করছেন অনেকে এটা যেমন ঠিক, আবার এটিও ঠিক যে এই কাজেরও মজুরির কোন স্থিরতা নেই, কাজেরও কোন স্থিরতা নেই, কাজের পরিস্থিতিরও কোন স্থিরতা নেই। এই সব ধরণের কাজের স্থিরতা আনার দায়ত্ব কার নেওয়ার কথা ছিল? নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল না? এ বিষয়ে নির্বাচনের আগে কেন চুপ করে আছেন শাসক বিজেপি দল এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দল? কেন কেউ জবাবদিহি করবেন না কোভিডের সময়ে বিল পাশ করে শ্রমকোড এনে দেশ থেকে ন্যুনতম মজুরির কথা তুলে দিল নির্বাচিত বিজেপি সরকার? দেশের পরিবারগুলির আয় কমানোর পথ প্রশস্ত করল নির্বাচিত সরকার। কি করেছিল সেই সময়ে সংসদে তৃণমূল কংগ্রেস দলের সাংসদেরা? কেন তাঁদের প্রাক নির্বাচনী কথায় ন্যুনতম মজুরির কথা থাকে না?

বামপন্থীদের তো বহুদিন থেকেই এ বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা আছে তারা কি চায়? বামপন্থীরা শ্রম কোড বাতিল করে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে। কাজের অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে দাবি করে আসছে বামপন্থীরা। মানুষের আর্থিক সংস্থান করবার অর্থও তো রয়েছে দেশের ভিতর। চরম আর্থিক বৈষম্য চোখের সামনে এসেছে আমাদের। ধনী এবং অতি ধনীদের সম্পদ দেশের সম্পদের সিংহভাগ।তাঁদের প্রত্যক্ষ করের বোঝা বাড়িয়ে দেশের আমজনতার উপর থেকে পণ্য পরিষেবা কর সহ অন্যান্য পরোক্ষ করের বোঝা কমালে উপায় হয়। কিন্তু এই সব নীতির কথা মুখে নেই কেন নির্বাচিত শাসকদলের? মানুষের কাজ কি করে হবে? জীবন জীবিকার সংকট কাটবে কি করে? লোকসভা নির্বাচনের আগেও এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোন দায় নিচ্ছে না শাসকদল। উত্তর দেওয়ার মত উত্তর নেই শাসকের কাছে। যারা লুটে পুটে নিতে এসেছে দেশের সম্পদকে, তারা কি করে দেশের মানুষের কাজের কথা, কর্মসংস্থানের কথা আগে ভাববে? এই ভাবনার দায়িত্ব এই নির্বাচনে দেশের মানুষকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে সংসদে সুযোগ্য প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করে, যিনি দেশের মানুষের কাজের অধিকারকে, মজুরির অধিকারকে অগ্রাধিকার দেবে সংসদে।