দলিত নারীকে মন্দিরে লাঞ্ছনা, আম্বেদকরপন্থীদের চিরাচারিত মিছিলের ওপর  আক্রমণ, মুসলিম নিধন, শাহবানুর ধর্ষণকারী ও সন্তান-আত্মীয়দের হত্যাকারীদের ছেড়ে দেওয়া, তিস্তা শেতলাবাদকে জেল হাজতে বন্দি করে রাখা ইত্যাদি দুষ্কাণ্ডগুলি সর্ব সাম্প্রতিক কালের। এরকম এবং এর থেকেও অনেকগুণ বেশি সংগঠিত অপরাধ আগুনের লেলিহান শিখার মতো প্রায় এক দশক ধরে সারা ভারতে লক লক করছে। বেপরোয়া দাপটের সঙ্গে চলছে এসব। একমাত্র ব্যতিক্রমী রাজ্য কেরালা।

 বিজেপি’র সব থেকে বিশ্বস্ত মিত্র কে? এ রাজ্যের তৃণমূল সরকার। কেন? তার প্রমাণ কী?  

‘কেন’র উত্তর – এরা একই নাওয়ের সওয়ারি। অর্থনৈতিক পন্থা-পদ্ধতি সব এক। মানুষকে ধ্বংস করা যার মূল কথা। এবং সাম্প্রদায়িক আচরণেও বিজেপি’র বিশ্বস্ত মিত্র হয়ে উঠেছে তৃণমূল দলটি।

দেশে ও রাজ্যে চলছে, সরকার পোষিত বীভৎস দুর্নীতি, রকম হিংসার প্রাবল্য। একটা গা ঘিন ঘিন করা কদর্যতা! 

 ‘প্রমাণ’! –  অমিত শাহ আতঙ্কিত, বাংলায় বামপন্থীরা বাড়ছে কেন! আর ‘স্বস্তিকা’ বলে দিয়েছে – তৃণমূল থাকে থাকুক, কিন্তু বামপন্থীদের দিকে যেন মানুষ না ঝোঁকে।  আমরা কয়েক মাস আগে মোদীকেও দেখেছি, কেরালা রাজ্য নিয়ে ঊষ্মা প্রকাশ করে বলতে, বামপন্থীদের ‘বিচারধারা’ মারাত্মক। কমিউনিস্টদের মতাদর্শ সম্পর্কে তাদের ভয়ানক আতঙ্ক!

 সকল রকম ভাবে এদের মতদ দেয় কারা? দেশের ও বিদেশের হাঙ্গর পুজিপতি আর দেশের বড় বড় জোতের মালিক আর গ্রামীণ নতুন ধনবান ব্যক্তিবর্গ। পশ্চাতপদ ও জনবিরোধী কাণ্ডকারখানাগুলি চলে এদেরই বিপুল অর্থে। বিনিময়ে এদের স্বার্থ এই দুই সরকারকে যেন তেন প্রকারেন দেখতে হয়। দু’ তরফের মধ্যে আছে প্রকাশ্যে ও গোপনে মহা বন্ধুত্ব। 

ঐ মদতের অঙ্গ হিসাবে, বড় পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন সব প্রচার মাধ্যম এ’দু’দলের দিকে ঝোল টানে। টানা প্রচার করে, দেশে শুধু একটি দল – বিজেপি, আর রাজ্যে শুধু দুটি দল  – তৃণমূল আর বিজেপি বিদ্যমান।    

 এই অপশক্তি গুলির তথা এই দুই সরকারের ও দলের বিরুদ্ধে লড়াইটা খুব সোজা নয়। সোজা না হলেও সারা দেশ জুড়ে, সারা বাংলা জুড়ে সেই লড়াই শুরু হয়েছে। লড়াই এর মতো লড়াই! আমরা ইতিহাসে দেখেছি বিশ্বত্রাস হিটলার কেমন বাংকারে আত্মহত্যা করেছিলো, দেখেছি, হিংস্র মুসোলিনী পালিয়েও বাঁচতে পারে নি।

দেশে ও রাজ্যে মানুষের মধ্যে প্রতীতি সৃষ্টি হয়েছে বিজেপি – তৃণমূলকে পরাভূত করা যাবেই।

দুই

 আপনাদের রুশ দেশের একটা উপকথা শোনাই –

 একদিন সকালে বুড়ো শীত ছোট শীতকে বলল – বাবা আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। দাঁতও সব পড়ে গিয়েছে। এখন আর মানুষ কাবু করতে পারছি না। তুই আজ থেকে দায়িত্ব নে। ছেলে তো একপায়ে খাড়া। এতোদিন ওর শরীর নিশপিশ করেছে। জোয়ান মরদ সে। তবুও এখনও দায়িত্ব পায় নি।

বাবাকে বলল – বল বাবা, কাকে কাবু করতে হবে?

-আজ শুনেছি দেশের রাজা পাত্র অমাত্য সঙ্গী সাথীদের নিয়ে শিকার করতে বেরবে এই একটু পরেই। যা তো ওকে কাবু করে আয়। দেখিতো কেমন পারিস!

রাজা তো শীত ঠেকানোর জন্য যা যা শরীরে চাপানো দরকার সবই চাপিয়েছে। দামি দামি সব পশমি পোশাক। মাথায় মোটা পশমি টুপি, গায়ে কয়েক পরস্ত জামা, তার উপর অলেস্টার। কোমড় থেকে পা পর্যন্ত সে রকমই প্যান্ট। পায়ে চামড়ার মোজা, চামড়ার জুতো।

খোস মেজাজে রাজা সঙ্গীদের নিয়ে বেরলো শিকার করতে।

এদিকে ছোট শীতও ফুর ফুর করতে করতে এসে গেল। ও রাজার মাথার চুলের ভিতরে একটু ঢোকে। রাজার মাথায় এক ঠান্ডা প্রবাহ বয়ে যায়। সে ওখান থেকে বেরিয়ে রাজার নাকে একটু বসে, কানে একটু বসে, জামার ভিতরে দিয়ে ঢুকে গায়ে একটু সুরসুরি দিয়ে আসে। একটু পায়ের দিকে যায়।  জোয়ান শীতের শক্তিই আলাদা। রাজা একেবারে কাবু হয়ে যায়। তার দাঁত ঠকঠকানি শুরু হয়ে যায় সে হিহিহিহি করে কাঁপতে থাকে, নাক দিয়ে কাঁচা সর্দি গড়াতে থাকে। আর কী করে! তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে মোটা বিছানায় শুয়ে, কয়েকটা লেপ গায়ে চাপায়।

ছোট শীত ফুরফুর করে বাবার কাছে এসে বলে – বাবা তোমার দেওয়া দায়িত্ব পালন করে এলাম। প্রথমেই তুমি দেশের রাজাকে কাবু করতে পাঠিয়েছিলে। যাক বাবা, বেটা রাজাকে একেবারে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছি।

বাবা বলল – শাবাশ! কিন্তু ব্যাটা আর একটা পরীক্ষা দিতে হবে।

-কী?

-ঐ যে কাঠুরেটা কুড়াল নিয়ে কাট কাটতে যাচ্ছে, ওকে কাবু করে আসতে হবে।

ছোট শীত মনে মনে হাসে। রাজাকে কাবু করে এলাম। আর এ এক ভুখা নাঙ্গা, পরনে যার কাপড় প্রায় নেইই, তাকে কাবু করতে পাঠাচ্ছে বাবা! মুখে বলল – বাবা আমি চললাম।

কাঠুরের মাথায় একটা ছেঁড়া টুপি। ছোট শীত সেটা ভেদ করে মাথায় বিলি কাটল। কাঠুরে মনে মনে বলে – এ আবার আজকে কোন আপদ! ব’লে, জোরে জোরে হাঁটতে থাকল। ছোট শীত এরপর কাঠুরের পেটে, পিঠে, পায়ে তার কামড় বসাতে শুরু করল। কাঠুরের একই কথা – এ কোন আপদ এল রে বাবা আজকে! এভাবে বলে আর জোরে জোরে হাঁটে। শরীরে একটু একটু আরাম হয়, ছোট শীতও কাঠুরের শরীরটাকে জুৎ মত কাবু করতে পারে না।

কাঠুরে একটা গাছের গুঁড়ির সামনে এসে হাত পা কে একটু ওঠা নামা করিয়ে কুড়ুল দিয়ে গুঁড়িতে চোট মারতে থাকে। ছোট শীত যথা রীতি ওকে কাবু করার জন্য বিরক্ত করতে থাকে।

কিন্তু কাঠুরে আরও জোরে জোরে কুঠার চালাতে থাকলে, ওর শরীর গরম হতে থাকে, মরদ শীতেরও অস্বস্তি হতে থাকে।

একসময় কাঠুরের এমন গরম ধরে যে, সে তার জামাটাকে খুলে পাশে ঘাসের উপর রেখে দেয়।

জোয়ান শীত আর কী করে! বুদ্ধি বের করে – এখন কিছুক্ষণ ঐ রেখে দেওয়া জামাটার মধ্যে ঢুকে থাকি’। পরে যখন জামা পড়বে, মাথায় খড়ির বোঝা নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেবে, তখন ব্যাটাকে এমন জব্দ করব না! আমাকে অপমান করার মজা বুঝিয়ে দেব একেবারে।

কাঠ কাটা হয়ে যায়। কাঠুরে হাঁপাতে থাকে। ঘাম ঝরছে শরীরে। একটু ক্লান্তি হচ্ছে। ও জামাটার পাশে ঘাসের উপর বসে পরে। দেখে জামাটা নড়ছে। কী ব্যাপার বাতাস-টাতাস কিচ্ছু নেই। জামাটা নড়ে কেন।

আবিস্কারের আনন্দে মিচকি হেসে মনে মনে বলে, ওরে ব্যাটা শীত তুই জামার মধ্যে ঢুকে আছিস! দাঁড়া তোর মজা দেখাচ্ছি!  ভাবনা মতো কাজ। কুড়ুলটার উলটো দিক দিয়ে জামার ওপর চোট মারতে থাকে। জোয়ান শীত – ওরে বাবারে মলাম রে – বলে চোঁচা দৌড় দিয়ে বাড়িতে এসে বাবাকে বলে – বাবা এ তুমি কাকে কাবু করতে পাঠিয়েছিলে? একটু হলে আমি মরেই যেতাম।

তারপর সব বৃত্তান্ত বলে বাবাকে।

বাবা বলে – শোনরে ব্যাটা, যারা বসে খায়, তাদের কাবু করা সহজ, আর যারা খেটে খায় তাদের কাবু করা কঠিন।

তিন

তার মানে চাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খেটে খাওয়া মানুষের জোট। তাদের লড়াই। তাহলে আমাদের দেশের আর রাজ্যের শোষক – শাসকরা পালাবার পথ পাবে না।

এই উপাদানই মূল। লাট্টু যেমন তার মাঝখানে থাকা আলের ওপর দাঁড়িয়ে বন বন করে ঘোরে – এই উপাদানটা হলো তাই। কিন্তু লাট্টু তো শুধু ঐ আলটা নয়, তার চারপাশে গোল হয়ে থাকে কাঠ। তেমনই খেটে খাওয়া মানুষের পাশে থাকা চাই গণতান্ত্রিক মানুষের বিভিন্ন বর্গের ঐক্য।

সেইজোটবদ্ধ লড়াইয়ের কাজটা সংগঠিত করতে হয় লাট্টূর লেত্তি মানে বামপন্থী দল দলগুলি, সংগঠণগুলিকে। জেদ নিয়ে আর তেজ নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডকে অনেক গুণ বাড়াতে হবে। তাহলেই জনগণের অপ্রতিরোধ্য জোট গড়ে উঠবে। জয় হবে মানবতার। হবেই।