প্রায় আঠারো দিন ধরে চলা ভারতের মহিলা কুস্তিগিরদের  যন্তরমন্তরের দীর্ঘ অবস্থান হতে পারতো আরও  দীর্ঘ। কারণ চলতি বছরের গোড়ায় জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক খ‍্যাতিসম্পন্ন মহিলা কুস্তিগির  ভিনেশ ফোগট পাতিয়ালার জাতীয় শিবিরে মহিলা কুস্তিগিরদের যৌনলাঞ্ছনার অভিযোগ তুলেছিলেন যার প্রতিবাদে ১৮ ই জানুয়ারি যন্তরমন্তরে জাতীয় পতাকা নিয়ে ভিনেশ ফোগট  সাক্ষী মালিক সহ মহিলা মল্লবীরেরা প্রতিবাদ অবস্থানে বসেছিলেন যাঁদের সমর্থনে ছিলেন বজরং পুনিয়ার মতো খ‍্যাতনামা পুরুষ মল্লযোদ্ধারাও । তখনও প্রধানত অভিযোগের আঙুল উঠেছিল জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে। ভিনেশ ফোগট সাক্ষী মালিকরা বলেছিলেন তাঁর স্নেহধন‍্য প্রশিক্ষকরা মহিলা কুস্তিগিরদের যৌনলাঞ্ছনা করে থাকেন। যা তখনও  ব্রিজভূষণ অস্বীকার করেছিলেন। কুস্তি নিয়ামক সংস্থার সহকারী  সচিব বিনোদ তোমর অবস্থানরত কুস্তিগিরদের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস পাওয়ার পর তখনকার মতো অবস্থান উঠে যায়,যে সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে আজ সাক্ষী মালিকরা মনে করছেন। সে সময় মেরি কমের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি তৈরি হয়েছিল কিন্তু সেখানে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে ক্লিনচিট দেওয়া হয় এবং অভিযোগকারীদের মিথ‍্যাবাদী বলা হয়। অথচ ভিনেশ ফোগট খুনের হুমকি পর্যন্ত পেয়েছিলেন। ব্রিজভূষণ আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন‍্য বলেছিলেন যে এই সফল ক্রীড়াবিদেরা ট্রায়াল না দিয়ে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছেন বলেই এই বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। অন‍্যদিকে বিশেষত ভিনেশ ফোগটের বিরুদ্ধে একটা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে,টোকিও অলিম্পিকে ব‍্যর্থ হওয়ার পর ব্রিজভূষণ তাঁকে “খোটে সিক্কে “অর্থাৎ “”অপদার্থ বলায় ভিনেশ ফোগট প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

  দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রধান সমস‍্যা এটাই যে প্রশাসনের দিকে অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগের আঙুল উঠলে সেই রাজনীতির নেতা মন্ত্রীদের কাছে জনগণের আস্থা বিশ্বাস আশা ভরসার কোন দাম থাকেনা। ভারতের জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনে তাঁর গ্রেফতারির দাবি তুলে নয়াদিল্লির যন্তরমন্তরে ভারতের আন্তর্জাতিক খ‍্যাতিসম্পন্ন মহিলা কুস্তিগীররা যখন অবস্থান বিক্ষোভ করছেন তখন “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও “শ্লোগান তোলা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা তাঁর মন্ত্রীসভার কোন সদস‍্যকে যেমন তাঁদের সঙ্গে কোন আলোচনায় বসেন নি,  তেমনি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রক কোন ব‍্যবস্থা নেন নি। গত আঠারো  দিন ধরে অবস্থান বিক্ষোভে বিশেষ কাজ হয়েছে এমন নয়। বরং দিল্লি পুলিশ রাতে হামলা চালিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের হয়ে পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের ওপর। মহিলা পুলিশের বদলে পুরুষ পুলিশ কুস্তিগিরদের শারীরিক নিগ্রহ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। অলিম্পকে স্বর্ণপদক জয়ী কুস্তিগির সাক্ষী মালিক সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে সর্বোচ্চ  আদালত দিল্লি পুলিশের অবস্থান জানতে চাইলে দিল্লি পুলিশ জানায় যে তারা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এফ আই আর করবে। আপাতত দুটি এফ আই আর জমা পড়েছে ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। এবার আন্দোলনরত মহিলা কুস্তিগীরেরা নাছোড়বান্দা। যতক্ষণ না ব্রিজভূষণ কে গ্রেফতার করা হবে ততক্ষণ তাঁরা অবস্থান চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। গত আঠারো দিনের মধ‍্যে এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে অবস্থান মঞ্চে এসেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেত্রী বৃন্দা কারাত,কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সহ অনেকেই। যে কারণে সর্বভারতীয় কুস্তি নিয়ামক সরকারের সভাপতি ব্রিজভূষণ যিনি বিজেপি সাংসদ তিনি আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের বিরোধী রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রভাবিত বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু শুরু থেকেই তো অভিনব বিন্দ্রা পিভি সিন্ধুর মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতকে সম্মান এনে দেওয়া ক্রীড়াবিদরা এই আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের সঙ্গে ছিলেন। সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন কপিলদেবের মত কিংবদন্তিও।  কিন্তু নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহ তো অজয় সিং টেনি যাঁর পুত্র উত্তর প্রদেশে আন্দোলনরত কৃষকদের গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা গ্রহণ করতে দ্বিধায় ছিলেন। দীর্ঘ বারো বছর ধরে সর্বভারতীয় কুস্তি নিয়ামক সংস্থার সভাপতি পদে থাকা বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার শুভবুদ্ধি তাঁদের কাছে আশা করা যায় না। উপরন্তু এখন তো বিজেপি সরকারের কৃষক বিরোধী নতুন কৃষি আইন প্রত‍্যাহারের আন্দোলনে  সামিল কৃষকরা এই কুস্তিগিরদের ধর্ণামঞ্চে সমর্থন জানাতে পৌঁছে যাওয়ার পরে এই আন্দোলনকে  সম্পূর্ণ রাজনৈতিক শত্রুতার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।

সরকারের এই মনোভাব বুঝতে পেরেছেন কুস্তিগিরেরাও। ভিনেশ ফোগট সাক্ষী মালিকরা তাই দাবি জানাচ্ছেন,কোনভাবেই যেন উত্তরপ্রদেশে কুস্তির জাতীয় শিবির না করা হয়। কারণ উত্তরপ্রদেশের গোণ্ডা  থেকেই নির্বাচিত সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং। ছেষট্টি বছর বয়সী ব্রিজভূষণ কোন প্রাক্তন কৃতী কুস্তিগির নন বরং বাবরি মসজিদ ভাঙার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে টাডা আইনে মামলা চলছিল।