“আজ খুশ তো বহুৎ হোঙ্গে তুম”। দিওয়ার সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। সেই সিনেমাতে যে কখনো মন্দিরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি সে অসুস্থ মা’র কাছে পৌঁছানোর সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জীবনে প্রথমবারের জন্য মন্দিরে গিয়েছিল। নিজের জন্য নয়, মা’র আরোগ্য কামনা করতে। তার এই প্রার্থনার ফলেই হোক, কিংবা স্ক্রিপ্ট রাইটারের হাত যশের ফলেই হোক প্রার্থনাকারীর মা ফিরে এসেছিল।

নির্বাচনের ঢাকে’ কাঠি পড়বার অনেক আগে থেকেই বাজার গরম করার জন্য নানান কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। এটা আগে থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও ISF মিলে যে ‘সংযুক্ত মোর্চা’ গঠন করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে যে জোট গঠন করা হয়েছিল তা হয়ত এবার থাকবে না। এই জোট যাতে গঠন না হতে পারে তার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টার পরেও জোট গঠন হয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সমস্ত অপ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এসব কথা আমরা সবাই জানি। সেদিনের মিডিয়ার ভূমিকাও আমারা জানি। আমরা এটাও জানি যে বর্তমান ভারতের বেশিরভাগ মিডিয়া হাউজগুলির মালিকানা স্বত্ব আম্বানী-আদানীদের দখলে। এতসব জানা স্বত্বেও আমরা মিডিয়ার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিই। আসলে যেখানে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যখন এতো পার্থক্য থাকে তখন, সাধারণ মানুষের বিশেষ কোনও মতামত থাকে না। মালিকের মতামতই তখন জনসাধারণের মতামত হয়ে ওঠে। ঋত্বিক ঘটকের “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো” সিনেমাটিতে সেই বিখ্যাত সংলাপটির কথা মনে পড়ছে, “নে জনগণ, চোলাই খা”। মালিকপক্ষ তো আজীবন চোলাই খাইয়েই রাখতে চায়, যাতে সে প্রশ্ন না করে। সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা ভাবনা করতে না পারে। বর্তমান মিডিয়া কি সেই কাজটাই করছে না?

সংযুক্ত মোর্চা গঠনের আগে ঠিক এই দোটানাটাই সৃষ্টি করেছিল বাজারি মিডিয়াগুলি। শাঁখের করাত। যেতেও কাটবে আসতেও কাটবে। বামফ্রন্টের নেতা কর্মীদের মধ্যে কিন্তু এতটুকুও দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব ছিল না। কেননা তারা ভাল করেই জানতেন যে, আমরা কি করছি এবং কেন করছি। তারা সচেতন ভাবেই এটা করেছিলেন তাই আব্বাস উদ্দীনকে বুকে জড়িয়ে নিতে এতটুকুও কুন্ঠা বোধ করেননি, কার্পণ্যও করেনি। নেবে নাই বা কেন? বদ হাওয়ার বিরুদ্ধে যে দাঁড়াবে তাদের সাথেই বামপন্থীরা থাকবে। আবারও যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে আবারও ধরবে। কেননা, বামপন্থীরা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। মেহনতিদের স্বার্থ ছাড়া তাদের আর কোনও স্বার্থ নেই। চুড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজত্বে যা বারবার আক্রান্ত হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের ফ্যাসিস্ত এই দুই সরকারের সাঁড়াশি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত সাধারণ মানুষের সেই জোট গঠনে বামপন্থীরা দক্ষতা দেখিয়েছিল। আম্বানী-আদানীদের মালিকানাধীন মিডিয়া তা নিয়ে কম কুৎসা করেনি। ডে-1 থেকেই শুরু হয়েছিল কুৎসার। তা সে ব্রিগেডের মিটিংই হোক কি এক সাথে মিছিল করা নিয়েই হোক।

বাইরে থেকে তখন এই জোট ভাঙতে না পারলেও ভিতর থেকে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র সমানেই চলছিল। যার সর্বশেষ পরিণতি জোট থেকে ISF-এর বেড়িয়ে যাওয়া। সেদিনের সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনে সমানে বলে যাওয়া নৌসাধকে কেমন নিঃস্পৃহ লাগছিল। আসলে শেষ দু-তিন মাসে মিডিয়ার সামনে বকবক করে এতো ফাউল করে ফেলেছেন যে পার্টির সাংবাদিক সম্মেলনে লাল কার্ড দেখে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না ওর কাছে। ওকে দেখে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল। একেই বলে রাজনৈতিক অদক্ষতা। বেচারা বুঝতেই পারলো না, কি করে প্রচারের আলোয় রেখেই প্রচারের আলো থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। ফোকাসে রেখেই কৌশলে ফোকাস থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো নৌসাদকে। এটা সম্পূর্ণ মিডিয়ার কৃতিত্ব। মালিকের নির্দেশেই তারা এই কাজ করেছে। ISF যা দাবি করেছিল তা অসম্ভব শুধু নয়, তা অবাস্তব। স্রেফ মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে এই অসম্ভব দাবি, যা রাজনৈতিক ভাবে আত্মহত্যার সমান। রাজনৈতিক দল কোনও জমিদারি নয়, আর দলের কর্মী-সমর্থকরাও দলের প্রজা নন। ISF-এর নেতাদের এটা বোঝা উচিত ছিল। তারা এটা ভাবলেন না, তাদের এই আত্মহত্যার সমান সিদ্ধান্তের ফলে আসলে কাদের লাভ হবে। তাদের এহেন রাজনৈতিক অপরিপক্কতার ফলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা আজ উল্লোসিত। এখন মেহনতি মানুষের লড়াইটা আরও মজবুত করতে বামপন্থীদের বাস্তব পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে তা কোনও রকম রাখঢাক না রেখে খোলাখুলি ভাবে বলতে হবে, বলতে হবে মিডিয়ার ভূমিকার কথাও। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তাদের অংশীদারিত্বের কথা। মিডিয়ার এই সাফল্যে মালিক, খুশ তো বহুৎ হোঙ্গে তুম। নির্বাচনী বন্ডের বেলায় এই মিডিয়ার কলমেই নিরোদ লাগানো থাকে। সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলিও যে এখন মালিকের নির্দেশেই  করা হয় তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?

ISF-এর ঐতিহাসিক এই ভুল সিদ্ধান্তের ফলে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সেই লড়াইতে জয় পাওয়া একটু হলেও কঠিন হয়ে পড়েছে, কিন্তু তা অসম্ভব নয়। দৃঢ়তার সাথে এই লড়াইটা করতে পারলে আগামী দিন নিশ্চিত ভাবেই সামগ্রিক ভাবে মেহনতি মানুষের এই লড়াই সাফল্যের মুখ দেখবে। রাত যতই গভীর হয়, ভোর ততই কাছে আসে।