সাম্প্রতিক সময় রাজ্যের দ্বিতীয় স্থানাধিকারী মন্ত্রীর কেলেঙ্কারি বড় খবর। সুদীর্ঘ ঐতিহ্যমন্ডিত বাংলা আবার কলঙ্কিত। রাজ্যের শাসকদলের শীর্ষস্থানীয় একডজনের বেশি নেতা–মন্ত্রী–সাংসদ –বিধায়ক বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিপুল অর্থ উৎকোচ গ্রহণের সংবাদ রাজ্যবাসীর নজরে আছে। এ অপরাধ বিচারের পরে চূড়ান্ত রায় কবে ঘোষিত হবে তা রাজ্যবাসীর আজও অজানা-আদৌ তা জানা যাবে কিনা, তাও স্পষ্ট নয়।

দেশের প্রায় সর্বত্র চুরি-দূর্নীতির কলঙ্কের কালি ছড়িয়ে আছে। প্রায়শই তা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো একটি রাজ্যের শাসক দলের সর্বোচ্চ স্তরের এত বিপুল সংখ্যক নেতা দূর্নীতির দায়ে কালিমালিপ্ত হয়েও নির্দ্বিধায় সরকারী দপ্তর আলোকিত করে,বসে আছে এবং সরকারী গাড়ীতে লাল আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন দৃষ্টান্ত বিশাল ভারতবর্ষে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?

এদের নিজের কোনো লজ্জাবোধ বা আত্মমর্যাদার বালাই নেই, একথা বলাই বাহুল্য। তাদের উপর দলীয় অনুশাসনও নেই, এ বিষয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। একটি দলের এতো বিপুলসংখ্যক নেতৃত্ব নির্দ্বিধায় যারা এমন কাজে নিজেদের কলঙ্কিত করতে পারলেন, তাদের মধ্যমণিরা দেব-দেবী হওয়ার কথা নয়। কারণ দেব-দেবীর গুণ সমৃদ্ধ মানুষদের ঘিরে। এত অসৎ-দের সমাবেশ থাকার কথা নয়। বিপরীতে বিপুল সংখ্যক অসৎ মানুষের মধ্যমণি দেব-দেবী হওয়া অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহিত্যক বুদ্ধদেব গুহের একটি আলোচনা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সহ অনেকের নাম করে বলেছেন, এরা গাড়ি, বাড়ি,অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতি করতে আসেন নি। এদের উপার্জনের যোগ্যতা ছিলো। জ্যোতি বসুর চারপাশের এই লোকদের দেখেই বোঝা যায় জ্যোতি বসু কেমন লোক। কিন্তু কালিঘাট এলাকার একটি প্রাচীন জনবসতি এলাকা বর্তমানে ব্যানার্জী পাড়া নামে পরিচিত হয়েছে। ব্যানার্জী পরিবারের বসবাস বলে পাড়াটি ব্যানার্জী পাড়া নাম পায়নি। এলাকার মহামূল্য অনেকগুলো বাড়িতে একি পরিবারের মালিকানা কায়েম হয়েছে বলেই সম্প্রতি ব্যানার্জী পাড়া নাম অর্জন করেছে।

সম্প্রতি স্বনামধন্য পার্থ চট্টপাধ্যায়ের বিপুল নগদ অর্থ, সোনা, বাড়ি জমির হদিশ মিলেছে, তাকে তদন্তকারীদের জিজ্ঞেসাবাদের ভিত্তিতেই। এই ঘটনার আগে পযর্ন্ত শীর্ষ নেত্রী, যিনি আবার দলের সকলের কাজের অনুপ্রেরণার স্থল, অতিদ্রুতই বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতেন। ‘ছোট ছোট ছেলেদের কাজ, ছোট ভুল অনেক ভালো কাজের মধ্যে কিছু ভুল’;’অপপ্রচার’ প্রভৃতি অপরাধ লঘু করার অজুহাত শুনতে রাজ্যবাসী অভ্যস্ত। কিন্তু এবার তিনদিন পর্যন্ত গুরুতর ঘটনার কোনো বাণী না পেয়ে রাজ্যবাসী বেশ বিস্মিত। তার দক্ষিণ হস্ত, স্বয়ং কল্পনাতীত চুরির দায়ে ধরা পড়ায় তাকে নির্বাক থাকতে হলো। এবার বিপুল নগদ টাকা, জমি-বাড়ির দলিল, সোনা প্রভৃতি গস্তদার কিছু বান্ধবীরও সংবাদ প্রকাশিত হলো।

তিনটে দিন পার হওয়ার পর গুণীজনদের পুরষ্কার বিতরণী সভায় বলেন; এত টাকা চুরি ! অথচ কেউ আমাকে জানাল না ! দলের সর্বময় কর্ত্রীর পক্ষে এমন উক্তি যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। যিনি বিভিন্ন সময় ঘোষণা করেন, সব কিছুই তার নজরে থাকে, তার মুখে এমন কথা কি অসত্য ভাষণ, না দায় এড়িয়ে যাওয়া ? এ প্রশ্ন মানুষের মধ্যে দেখা দেবেই। তিনদিনের সুচিন্তিত মতামতটি হয়ত উভয় দিক থেকেই সত্য-দায় এড়াতে হবে, অথচ সত্য কথা বলাও অসুবিধাজনক।

গুরুতর ঘটনার পরবর্তী কার্যক্রম হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী এবং তার ভাইপোর অবস্থানে যথেষ্ট পাথর্ক্য দেখা যায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের অন্দরে কর্তৃত্বের প্রশ্নে দলের অন্দরে বিরোধের প্রকাশও অনেকে দেখতে পাচ্ছেন। এমন বাস্তবতা থাকতেই পারে। মন্ত্রীসভায় নিজ প্রভাবাধীন লোকের ভীড় বাড়িয়ে নিজের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্য ভাইপোর থাকতেই পারে, তার সাথে ভাইপোর অবস্থানে পার্থক্য মোটেই অস্পট নয়।

টাকা লুটের যে পর্ব প্রকাশ হয়েছে, তার পরিণতি এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ব্যাপ্তি যে বিপুল,এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিষয়টি কোন পর্যন্ত গড়াতে পারে, এখনও স্পষ্ট হয়নি। সামান্য নীচু তলার কর্তাব্যক্তিরা যে পরিমাণ লুটের অর্থ সংগ্রহ করেছে এবং সংগৃহীত অর্থের ভাগ নিয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে, তাতে এক্ষেত্রে কিছু না জানার ভাব করা নিতান্তই হাস্যকর। নীচু তলার লুটের ভাগ নিয়ে গণহত্যা পর্যন্ত পরিণতি পায়। সেক্ষেত্রে ক্ষমতার কেন্দ্র দখল ও বিপুল লুটের ভান্ডার দখলের লড়াই খুব কম পরিসরে সীমিত থাকতে পারে না।

ক্ষমতা ও অর্থলুটের পরিসর কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপি-র অগোচরে নয়। তাই দিল্লীর কর্তারা কখনও, কখনও বিশ্রাম, কখনও ভয় দেখান, কখনও বা তথ্য প্রচার এমন সব খেলায় লিপ্ত। তাদের প্রয়োজন তৃণমুল দলতথা নেত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করার। আলোচ্য বিষয়টি তার বাইরে নয়। বিজেপি সে লক্ষ্যেই কাজ করছে।

এর বাইরেও একটি দ্বন্দ্ব বিকশিত হচ্ছে, শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং পশ্চিম বাংলার জনগণ। বিপুল লুট এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্মম আক্রমণের পরিণতি রাজ্যের জনগণের পক্ষে ভয়ঙ্কর প্রতিকূল। শাসক দলের উচ্চ নেতৃত্ব বিব্রত। অন্য নেতা ও সাধারণ কর্মীরা যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত। যে স্বৈর শাসন চলছে, তা কার্যকরী করা এই দ্বিধাগ্রস্ততা নিয়ে বেশ অসুবিধাজনক। মানুষের প্রতিবাদ যতটা শক্তি অর্জন করবে, ততটাই স্বৈরশাসনের শক্তি দুর্বল হতে বাধ্য। আমাদের দেশে বা রাজ্যে অতীতে এমন অভিজ্ঞতার অভাব নেই, যার পরিমাণে গণতান্ত্রিক শক্তি অগ্রসর।

সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান ঘটনাটি দেখতে হবে। যে ভয়াবহ উদ্যোগের চিত্র সামনে এসেছে, তাতে কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের পরির্বতে পরীক্ষায় অকৃতকার্যরাই হবে শিক্ষক, কারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই না করে অর্থের মূল্যেই শিক্ষক নিয়োগ হলে,শিক্ষক বা শিক্ষার মান কেমন হতে পারে? ছাত্ররা কি শিক্ষা পাবে? শিক্ষকের সন্মানীয় পদ বিক্রয়ের পণ্য হলে, ছাত্র এবং অভিভাবক কোন দৃষ্টিতে শিক্ষকদের দেখবে? এসব হাড় হীম করা প্রশ্ন সামনে ভীড় করছে।

সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ ; পার্থ চ্যাটার্জী নিজে অতিশয় সাধু বা সজন ব্যক্তি। এই বিপুল সম্পদ এবং টাকার পাহাড় নাকি তার নয়। দলের বলেই ইঙ্গিত। যদিও তার বান্ধবী ইতিমধ্যেই বলেছেন, দলের বলেই তার কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। দলের হয়ে জনগণের টাকা ডাকাতি করা অপরাধ নয় কি? আপনারা ভাগ পান নি? আজ উত্তর দিতে হবে জনগণের কাছে। শিক্ষা এবং সমাজের নৈতিক মান তাই বিপন্ন। শিক্ষক নিয়োগের এই ঘটনায় গুরুতর প্রশ্ন উপস্থিত হচ্ছে। রাজ্যের অধিকাংশ অধিবাসী আর্থিকভাবে বিপন্ন। তাদের সার্মথ্য নেই মন্ত্রীদের টাকা সংগ্রহের বিপুল ক্ষুধা মেটাবার, এমনকি বসতবাটি বিক্রয় করেও না।

শিক্ষা সর্ম্পকে, জন্মাবে ভয়াবহ হতাশা। জীবন সংগ্রামে উদ্যোগহীন হবে যুবকরা। সারা দেশের ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতায় এরাজ্যের ছাত্রদের ভালো অবস্থান থাকে। যে অবস্থান ভেঙ্গেঁ চূড়মার হয়ে যাবে। তাই অন্ধকারের এ শক্তিকে আজ প্রতিহত করতে হবে। বাঁচাতে হবে রাজ্যের ভবিষ্যৎ। বর্তমান লড়াই রাজ্যের ভবিষ্যৎ বাঁচানোর লড়াই। রসালো গল্পগাথা বা ক্ষমতা কর্তৃত্বের কাছে রাজ্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন করা যাবে না।