গত ১৫৷০৯৷২২ তারিখে প্রথম পর্বের লেখাতে শেষ করেছিলাম, ” ছাড়পত্র পাওয়া মাত্রই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অগণতান্ত্রিকভাবে শুরু করে দিলেন দেওচা –পাঁচামি –দেওযানগঞ্জ –হরিণশিঙা কয়লাখনির খোলা মুখের কাজ। “উনি শুরু করে দিলেন অথচ কোল ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই অলাভজনক প্রকল্প বলে এই প্রকল্প থেকে সরে আসে।কেন্দ্রীয় সরকার তখনই এই প্রকল্পের বিপুল খরচের কারনে পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ,তামিলনাড়ু ,কর্নাটক,–এই ছয়টি রাজ্যকে যুক্ত করে তৈরি করেন “বীরভূম কোলফিল্ডস লিমিটেড “।

এই লিমিটেডের ছয়টি রাজ্যের বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ ও সরকারের আধিকারিক এবং জনপ্রতিনিধিরা মিলিতভাবে বৈঠক করেন। প্রযুক্তিগত সমস্যা ও জটিলতা তারপর আছে বিপুল টাকা খরচ ,পরিশেষে খরচ ও লাভের অংশ নিয়ে  (অংশীদারিত্ব ) অর্থাৎ ভাগ বাটোয়ারার অনুপাত নিয়ে রাজ্যগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় ।অবশেষে পাঁচটি রাজ্য এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসে ।হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকার একাই আগ বাড়িয়ে ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রকল্পের দায়িত্ব নেবে বলে আবেদন জানায় ।প্রশ্নটা এখনেই। কোল  ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ অলাভজনক বলে সরে গেল। অন্য রাজ্যগুলিও সরে গেল। কোন্ উদ্দেশ্য সাধনে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করলেন? ?উদ্দেশ্য ও রহস্য কি ভবিষ্যতে জানা যাবে ।২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবেদন গ্রহণ করে এবং West Bengal Power Development Corporation Limited  (W B P D C L ) কে প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব দেয়। রহস্য এখানেই ।আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একাধারে সবজান্তা, যিনি কবি -সাহিত্যিক, শিল্পপতি, প্রযুক্তিবিদ, পরিবেশবিদ ,সর্বোপরি “চা- ঘুগনি- কাশফুলে’র বালিশ তৈরি, ফুচকা মেকিং এর কারিগর।উনি গবেষণা করে ঘোষণা করলেন ,”এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আগামী ১০০ বছরের জন্য রাজ্যকে আর বিদ্যুৎ উৎপাদন এর জন্য ভাবতে হবে না।

” আরও গর্ব করে বললেন, “পশ্চিমবঙ্গ আত্মনির্ভর হবে ।”এখন আত্মনির্ভর হবে না আত্মঘাতী হবে ভবিষ্যত বলবে ! দশ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা  করেছেন মুখ্যমন্ত্রী ।তারপর আছে প্রকল্প রূপায়ণের ব্যয়ভার ।যে রাজ্যের মাথার উপর পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা দেনা, সেই রাজ্য সরকার এই বিপুল পরিমাণ টাকার ব্যয় বহন করে প্রকল্পের কার্যকারিতা কতখানি সফল হবে সেই নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে ।সংবাদমাধ্যমগুলির একটা বৃহৎ অংশ মুখ্যমন্ত্রীর জয়গান করে ঢাক বাজাতে শুরু করলেন।আর যাদের ভিটে- মাটি চাটি হয়ে যাচ্ছে, আইন না মেনে জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণ করে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে ।সেটা সংবাদমাধ্যম আড়াল করার চেষ্টা করছে।সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে শিল্পের বিরোধিতা করে জমি অধিগ্রহণ ইস্যুতেই প্রায় নব্বই ভাগ হয়ে যাওয়া ন্যানো কারখানাকে ধ্বংস করে সেই ন্যানো কারখানাকে গুজরাটে পাঠিয়ে দিয়ে ক্ষমতালোভী মমতা ব্যানার্জি আত্মতৃপ্তির সাথে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেন। তারপর সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানাকে ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করলেন ।

ঐ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিই খোলামুখ কয়লাখনি রূপায়ণের জন্য প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে জোরপূর্বক আদিবাসীদের উৎখাত করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করছেন।এমনকি, ঐ এলাকার মধ্যে প্রবেশাধিকারের উপর রাশ টানা হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ।মমতা ব্যানার্জির দ্বিচারিতার মুখোশ এখানেই ধরা পড়ে যাচ্ছে ।কাদের স্বার্থরক্ষার জন্য মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এই খনি -প্রকল্প করার জন্য ছাড়পত্র নিলেন??উনিতো ইতিহাস অনেক পড়েছেন ,সবেতেই বিজ্ঞের ভাব দেখান আর স্বাধীনতা সংগ্রামে  আদিবাসীদের ভূমিকা উনি জানেন না? ?সেটা কি ইতিহাসের পাতাতেই লেখা থাকবে? সরকার কবে এদের প্রতি সহৃদয়তার সঙ্গে তাদের পাশে দাঁড়াবে ?স্বাধীনতার ৭৬  বছরে আদিবাসীরা কেমন আছে, তাদের বনভূমি থেকে কীভাবে অধিকার কেড়ে নিচ্ছে –তা অতীতের ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক ।ব্রিটিশদের রাজত্ব থেকে শুরু হল জঙ্গল ঘেরা বসবাসকারী আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা ।

শ্রেণীস্বার্থ, বৈষম্য, শোষণ এবং উৎপীড়নের বাসনায় ১৮৬৫ সালে তৈরি হল”বনবিভাগ”।বনজঙ্গলের উপর প্রথম থেকেই ইংরেজদের লোভ – লালসা  ছিল, তার সাথে ছিল দেশীয় জমিদার ও পুঁজিপতিদের একটা বড় অংশ ।তার জন্যই  তারা বন জঙ্গল ও অরণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে ১৮৭৮ সালে দেশের প্রথম “অরণ্য আইন” চালু করে।ঐ সময়েই “সংরক্ষিত অরণ্য “বলে  ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে।স্বাধীন ভারতে ১৯৪৯ সালে “সাঁওতাল পরগনা টেনান্সি অ্যাক্ট “তৈরি হয় ।ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পিছনে আদিবাসীদের যে লড়াই সংগ্রামের ভূমিকা ছিল, সেই আদিবাসীরাই স্বাধীন ভারতে আজ অচ্ছুৎ  রয়ে গেল ।১৯৫২ সালে অরণ্য নীতিতে অরণ্যবাসীদের অধিকারের বিষয়টাকে পাত্তাই দিল না ভারত সরকার ।১৯৭২ সালে তৈরি হয় “বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন “।১৯৮০ সালে তৈরি হল “বন আইন (সংরক্ষণ )”।এখানেও বনবাসী ও জঙ্গলবাসীদের কথা বাদ রয়েই গেল ।আদিবাসীদের বিপদ আরও ঘনীভূত হল১৯৮৮ সালের “রিজার্ভ ফরেস্ট অ্যাক্ট “এ।এই আইনের ফলে প্রায় এক কোটি আদিবাসী ও বনবাসী উচ্ছেদের কবলে পড়লেন । সরকারের কোন দায়ও নেই, দায়িত্বও নেই ।

২০০২ সালে বি জে পি সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেযী পাকাপোক্ত ভাবেই আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদ অভিযানে নামলেন ।দেশে সংবিধান আছে, সরকার আছে আর আছে আইন —-তা সত্বেও বর্তমানে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় দু কোটি ।আমরা স্বাধীন বলে গর্ব করি ।এরাই আমাদের দেশের আদিও অকৃত্রিম অধিবাসী, এরাই সম্পদের পাহাড় গড়ে, অথচ এরাই দেশের যাবতীয় সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে ।৫৬ ইঞ্চি ছাতির প্রধানমন্ত্রী গর্ব করে বলেন ,আদিবাসীদের যথাযথ উন্নয়ন নাকি তাঁর আমলেই হয়েছে ।তাই তাঁর গভীর আত্মোপলব্ধির সফল রূপায়ণস্বরূপ আমাদের দেশ প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মুকে পেয়েছে ।কিন্তু তাতে প্রত্যন্ত এলাকার আদিবাসী -বনবাসীদের উন্নতির চিন্তা কতটুকু আছে? আছে শুধু রাজনীতির সফলতর রূপায়ণ।আচ্ছে দিনের সরকার এর বন ও পরিবেশ মন্ত্রক গত ২০২২ সালের জুন মাসে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ।বিজ্ঞপ্তিটি হল ,”বনবাসী সংরক্ষণ ২০২২”–।

এই বিজ্ঞপ্তিটিতে  কি আছে দেখা যাক —–।***সংবিধানের পঞ্চম তপশীল –এ আদিবাসীদের যা রক্ষাকবচ ছিল, সেটাকে কার্যত অস্বীকার করে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে ।সংসদীয় রীতিনীতি ও গণতন্ত্র কে মান্যতা না দিয়ে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল। ফলে গ্রাম সভার অনুমতি ছাড়াই বনজঙ্গলসহ ভূমিকে কেন্দ্রীয় সরকার যে কোন বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিতে পারবে ।এই নিয়ম কার্যকর হলে,হাজারে হাজারে আদিবাসী বনবাসী উচ্ছেদ হবে ।এদের কোন দায় — দায়িত্ব রাজ্য সরকার নেবে কিনা তা যথেষ্ট সংশয় আছে ।কি হবে আদিবাসীদের অধিকার ও জীবন জীবিকা? *দেশের প্রথম নাগরিক রাইসিনার শীর্ষে বসা রাষ্ট্রপতি, একজন আদ্যন্ত আদিবাসী দ্রৌপদী মূর্মু কি পারবেন দেওচা –পাঁচামি কয়লা খনির খোলা মুখের সমগ্র এলাকার মধ্যে বসবাসকারী বিপন্ন  আদিবাসীদের বসতভিটে -মাটি -জঙ্গলকে রক্ষা করতে* ??? [তথ্য সংগৃহীত ] তারিখ  ২০৷০৯৷২২