৩য় ও অন্তিম পর্ব 

দ্বিতীয় পর্বে শেষ করেছিলাম, “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ ” এই স্লোগান কে বাস্তবায়িত করতে না দেওয়ার কৃষি এবং শিল্প দুটোকেই ধ্বংস করে দেওয়ার সুগভীর চক্রান্ত।হ্যাঁ, সুগভীর চক্রান্ত তো বটেই। ২০০৭ এর ১৫ ই ফেব্রুয়ারী বিশাল সমাবেশে মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “কৃষির সাফল্যের উপর দাঁড়িয়ে চাই আরো শিল্প”। এই জনসমাবেশে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী মাননীয় নিরুপম সেন তাঁর ভাষণে বলেন,” হলদিয়ায় পেট্রো কেমিক্যাল কারখানা গড়ে ওঠায় এখন সেখানে ৯০০ প্লাস্টিক কারখানা তৈরী হয়েছে। সেখানে অসংখ্য যুবক কাজ করছে……।

” সিঙ্গুরেও সেটাই হতো। টাটা প্রকল্পকে ঘিরে পাশাপাশি  অনুসারী শিল্প অসংখ্য গড়ে উঠতো। কৃষক ,ক্ষেতমজুর বাড়ির শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান হতো। এটা বুঝেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিথ্যার মোহজাল তৈরী করে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করলেন এবং টাটাকে চলে যেতে বাধ্য করলেন। তারপর ২০১১ সালে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করলেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে তাঁর দীর্ঘদিনের মনস্কামনা পরিপূর্ণ করলেন।ছবিসহ নিজের নাম প্রচারের উদ্দেশ্যেই সরলমতী ছাত্র-ছাত্রীদের “সদা মিথ্যা কথা বলিবে “শেখানোর লক্ষ্যে অষ্টম শ্রেণির পাঠপুস্তকে কৃষিজমির অধিকার : সিঙ্গুর গন আন্দোলন’ অধ্যায়টি অন্তর্ভুক্ত করলেন। এই অধ্যায়ের ১৬৩ পাতায় লেখা হয়েছে “শিল্পায়নের জন্য তারাই জমি  দিতে সম্মত ছিলেন, যাদের জীবিকা সিঙ্গুরের জমিখণ্ডের উপর নির্ভরশীল ছিলনা।”

এটি সর্বাংশে সত্যের অপলাপ ও কল্পনাপ্রসূত একটি দূরভিসন্ধিমূলক বিকৃত তথ্য। কারণ, জমির মালিক ছিলেন ১৩১৩৩ জন। সম্মতি দিয়েছিলেন ১০৮৫২ জন। ৫৬৮ জন কৃষক অনিচ্ছুক ছিলেন। তার মধ্যে ৭১ একর জমির মালিক প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জনের মতো দেশের বাইরে থাকতেন। মূলতঃ এদের জীবন-জীবিকা সিঙ্গুরের জমির উপর নির্ভরশীল ছিল না। উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখিত ঐ লাইনটির সারবত্তা আছে কিনা। ১৬৫ পাতায় রাজকুমার ভুল শহীদ হয়েছিলেন লেখা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ কী, তা কি ময়না তদন্ত করে নির্ধারণ করা হয়েছিল?মনে হচ্ছে তা হয়নি। পারিপার্শিক তথ্য থেকে জানা যায়, রাজকুমার ভুল ছিলেন একজন মৃগী রোগী, জলে পড়ে গিয়েই তাঁর মৃত্যু হয়নি তো ? যেকোনো মৃত্যুই দুঃখজনক, কিন্তু সেটাকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি আরো দুঃখের, আরো বেদনার। ঐ পাতায় লেখা হয়েছে, “জমি হারানোর শোকে আত্মহননের পথ বেছে নেন হারাধন বাগ ও প্রশান্ত দাস।” প্রকৃতপক্ষে এনাদের মৃত্যু জমি হারানোর শোকেই হয়েছিল, নাকি অন্য কোন শোকে! যে বিশেষজ্ঞ কমিটি এই অধ্যায়টি অনুমোদন করলেন, তাঁরা কি এই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখেছিলেন? পাঠকবৃন্দ ও অষ্টমশ্রেণির ছাত্রছাত্রীসহ অভিভাবক ও সুধী নাগরিকদের কাছে আমার বিনম্রঅনুরোধ এ সম্পর্কে সঠিক অনুসন্ধান করে সত্যটা জানুন। ঐ পাতায় আরও একটি মারাত্মক কথা লিপিবন্ধ রয়েছে, তা হল অনাহারে মৃত্যু হয় কৃষি শ্রমিক শংকর দাস ,শ্রীকান্ত শী,শংকর পাত্র-র”।সিঙ্গুরের মতো এলাকায় অনাহারে কেউ মরতে পারে এটা কেউ বিশ্বাস করবে? এতো গবেষণার বিষয়।

১৬৫ পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, “১৮ ডিসেম্বর জনৈক ভাগচাসীর মেয়ে তাপসী মালিককে বর্বরোচিত আক্রমণ করে হত্যা করা হয়।….. জমি রক্ষার আন্দোলনে এক দুর্ধর্ষ সৈনিক।” দুর্ধর্ষ সৈনিক- ই বটে! ক্রমশঃ প্রকাশমান।তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ড: একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র মামলা।এই ঘটনার পর বিরোধীপক্ষের দাবী মেনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিবিআই তদন্তের আদেশ দেন। এই মামলায় মূল আসামী করা হলো তৎকালীন সিপিআই(এম) এর সিঙ্গুর জোনাল কমিটির সম্পাদক সুহৃদ দত্ত ও সাধারণ কর্মী দেবু মালিককে। তাপসী মালিককে হত্যা ও বলাৎকারের অভিযোগে ২০০৭ সালের জুন মাসে সুহৃদ দত্ত ও দেবু মালিককে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। প্রায় দুবছর জেলে থাকার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কলকাতা হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করে।এই জামিন খারিজ করার জন্য সিবিআই  সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সিবিআইয়ের আবেদন খারিজ করে দেয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই মামলা কবে শেষ হবে?যদিও বিচারাধীন বিষয়। তা সত্ত্বেও বলা  যেতেই পারে যে ,বিচার না করে কতদিন এইভাবে তাঁকে অপরাধী হিসেবে দেগে রাখবেন? খুব পরিকল্পিত ও গভীর চক্রান্তের শিকার সুহৃদ দত্ত ও দেবু মালিক।কারন ,টাটা প্রকল্পের অধীন জমির মালিকদের কাছে গিয়ে, তাঁরা যাতে স্বেচ্ছায় জমি দেন, সেই প্রচেষ্টায় সুহৃদ দত্ত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।তার জন্যই তো সুহৃদ দত্ত ও দেবু মালিক যেদিন জামিনে মুক্ত হয়ে সিঙ্গুরে আসেন, সেদিন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এসে তাঁকে স্বাগত জানান।  রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানুষিক অত্যাচার তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। জেলের অভ্যন্তরে নারকো টেস্ট করার সময় একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। তার পরদিন থেকেই পা থেকে শুরু হল ঘা। তারপর গোটা শরীরে তা ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘা থেকেই ক্ষত, সেই যন্ত্রণা নিয়েই অকৃতদার ,সদাহাস্যময় অকৃত্রিম সরল মানুষটা আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। সত্য একদিন না একদিন উদ্ঘাটিত হবেই। তখনই জানা যাবে তাপসী মালিকের হত্যাকারী কে বা কারা? কারা তার দেহ পুড়িয়েছিল ।তাপসীর মৃত্যু রহস্য নিয়ে সিবিআই ক্রাইম ব্রাঞ্চের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন এস এস কে এম হসপিটালের ফরেনসিক এবং স্টেট মেডিসিনের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক গুপ্তা।

সেই রিপোর্টের একটি অংশ পাঠকদের অবগতির জন্য দেওয়া হল The appearance of the external os and the cavity of the uterus as seen by me on reviewing the video cassette appears to be in conformity with a case of abortion in recent past. In absence of the report verginal swab and smear i.e, whether spermotozoa or seminal fluid or DNA of a male subject are detected in them, it is not possible to opine definitly whether she was sexually violated in recent past i.e. prior to death. However further report may be submitted after receiving the above mentioned report.
Considering the findings in the post mortem report, the findings observed by me on reviewing of video cassette on post mortem examination of Tapasi Malik and visit to the place of detection of dead body of Tapasi Malik. I am finally opine that death of Tapasi Malik was due to the effects of ante-mortem burn injuries which were in probabil ity homicidal in nature as she was put to flame after incapacitating her by causing ante- mortem injuries especially  heamatoma (extravasation) over her head
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তাপসী মালিকের গর্ভপাত (abortion) করানো হয়েছিল। বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, তাপসী মালিক অবিবাহিতা ছিলেন। এক মহিলার মৃত্যু, মৃতদেহ পোড়ানো এবং গর্ভপাত খুবই দুঃখজনক হলেও এর কার্য-কারণ খুবই রহস্যময়।
অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের ১৬৬ পাতায় তৃতীয় প্যারায় লেখা হয়েছে, “২০১৬ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে গিয়ে কথা দিলেন জমিকে  চাষযোগ্য করে ফেরৎ দেবেন (সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী)। ২০ অক্টোবর সরষের বীজ ছড়িয়ে দিলেন, তার ছবিও এই পাঠ্য পুস্তকে আছে……….. – সম্পূর্ণ হল ১০,৪৩৬ জনকে জমির পরচা দেওয়ার কাজ।” পরচা তো দেওয়া হল, কৃষকরা জমির চৌহদ্দি ধরে নিজ নিজ জমি ফেরৎ পেয়েছেন কি? না, পরচা অনুযায়ী কার কত জমি তা চাষীদের সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিব্বি আছেন ! 


প্রকল্প এলাকায় জমির বেশির ভাগটাই কাশবন, আবার মাছের ভেড়ীও হচ্ছে। চাষ যেখানে হচ্ছে সেখানে কোনো কাঠামোই তৈরী ছিল না। জমি হিসাবেই পড়ে ছিল। আর ওখানেই মুখ্যমন্ত্রী সর্ষে বীজ ছড়িয়ে তার ছবি তুলে প্রচার  সেরেছেন। এই প্যারার শেষ লাইনে লেখা হয়েছে, ৯৯৭.১১ একর জমি চাষযোগ্য হয়ে ওঠে। এই ডাহা মিথ্যা কথা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো হচ্ছে, তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করানো হচ্ছে। তাই আমার অভিমত, ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষিক — শিক্ষিকা অভিভাবকদের শিক্ষামূলক ভ্রমণের অঙ্গ হিসাবে সিঙ্গুরে গিয়ে সেখানকার সঠিক পরিবেশ পরিস্থিতি অনুধাবন করা উচিত। সরলমতি বালক-বালিকাদের আসল সত্যি অবস্থাটা অবশ্যই জানা, শেখা উচিত বলেই মনে করি। ১৬৬ পাতার শেষের দিকে এই বলে শেষ করছেন যে, “পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য নেতৃত্বে এই আন্দোলন কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত করল।” এটি কি প্রকৃতপক্ষেই কৃষক, তথা গন আন্দোলন ছিল?নাকি  শিল্পায়নসহ কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে ধ্বংস করার আন্দোলন ছিল ?  পাঠকরা তা বিচার করবেন।
প্রথম পর্বে আমি  শুরু করেছিলাম, “আবার মিথ্যা ভাষন”। এ প্রসঙ্গে ২০২২ এর ২০ অক্টোবর আনন্দবাজারের প্রকাশিত খবরে প্রকল্প এলাকার খাসেরভেড়ির রবীন পোলেন বলেন ,”আমি টাটাদের কারখানার জন্য ৫২ বিঘা জমি দিয়েছিলাম……………তৃণমূলের ভুল আন্দোলনের জন্য তা হয়নি।”বেড়াবেড়ির বাসিন্দা অনন্ত বারুইয়ের বক্তব্য,”মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোটাই অসত্য …………।”গোপালনগরের জয়দেব  ঘোষ নামে এক অনিচ্ছুক চাষী বলেন, “দোষারোপ অনেক শুনেছি, আর শুনতে চাই না। এবার শিল্প হোক। জমি অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, চাষ আর হবে না।” ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা,” ২০০৮ এ টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে গুজরাটের সানন্দে চলে যান। সেখানে তৈরি ন্যানো গাড়ি বাজার না পেলেও টাটাদের অন্য গাড়ি তৈরি হচ্ছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে বহু মানুষের। সানন্দে টাটারা ইলেকট্রিক গাড়িও তৈরি করার পথে। এ সব খবরই পান সিঙ্গুরের চাষিরা। এখন তাঁরা হাত কামড়াচ্ছেন।এখন তাঁদের অনেকেরেই ,বক্তব্য,—“আন্দোলনের ফলে আমাদের আম ও ছালা দুই-ই গিয়েছে। না হয়েছে শিল্প, না চাষ।


তাহলে কি নতুন করে আবার ইতিহাস লেখা হবে। হয়তো ভবিষ্যতে হতেও পারে। তার কারণ ইতিহাস খুব নির্মম। সে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতালীয় রাষ্ট্রনীতিক নিকোলো মেকিয়াভেলীর তত্ত্বকে প্রয়োগ করেছেন। তাঁর রাজনীতির তত্ত্ব হচ্ছে রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধনে তথাকথিত অসদ্ উপায়ও নেওয়া যেতে পারে। মেকিয়াভেলীয় নীতি বলতে রাজনীতিতে প্রতারণা, হিংসা ও শঠতার আশ্রয় নেওয়া এবং অসাধু পন্থায় কলকাঠি নাড়া-ই বোঝায়। সিঙ্গুর আন্দোলনের বিরোধী নেত্রী বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিথ্যার মোহজাল বিস্তার করে এই রাজনীতির খেলাই খেলছেন। 

[তথ্য সংগৃহীত] তারিখ –২১।১১।২২