বাংলা জুড়ে আওয়াজ উঠেছে –“গ্রাম জাগাও বাংলা বাঁচাও “, “কত খেলে কত পেলে ?”চোর তাড়াতে সমস্ত মানুষ এক হও “। এই দাবিতে গ্রাম বাংলা মুখরিত। ক্ষেতমজুররা দাবি তুলেছে “জব কার্ডের বকেয়া টাকা দিতে হবে”। “জব কার্ডের কাজ বন্ধ কেন রাজ্য সরকার জবাব দাও।” “প্রকৃত গৃহহীনদের আবাস যোজনার টাকা দিতে হবে”। “আবাস যোজনায় ব্যাপক দুর্নীতি ও দলবাজি বন্ধ করতে হবে”। “সকল শিক্ষিত বেকারের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে “। এই দাবিতেই রাজ্য জুড়ে বুথে বুথে পদযাত্রা চলছে।সবেমাত্র ধান ফলতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও ধানের ফুল ঝ’রে পড়ছে, আবার কোথাও তাতে সোনালী রঙ ধরেছে , কোন কোন জমিতে ধান কাটা হয়েছে, ধান তুলছে ,আলু বসানোর প্রস্তুতি চলছে।

ধান গাছের সবুজ আর সোনালী রঙের আভা আর মাঝে আলপথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে লাল ঝান্ডাধারী পদাতিক বাহিনী যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে। গণসংগীতের তালে তালে, আদিবাসীদের নৃত্য ও মাদলের বোলে, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত — কৃষক, খেতমজুর, মহিলা, শ্রমিক, ছাত্র যুবদের দৃপ্ত পদযাত্রা গ্রাম থেকে গ্রামে,পাড়া থেকে পাড়ায় এগিয়ে চলেছে। পদযাত্রার লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। মুস্টিবদ্ধ হাত আরো দৃঢ় ও প্রসারিত হয়েছে।একালের পদযাত্রা ও সেকালের পদযাত্রা আশমান– জমিন ফারাক। তখনকার পদযাত্রার ধরন, বলন, শক্তি, গ্রামের আর্থ–সামাজিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক স্থিতিশীলতা ছিল এক আর এখন আরএক রকম। ১৯৮৩ সালের এক রোমাঞ্চকর পদযাত্রার কথা মনে পড়ল। সেই পদযাত্রা ছিল পুরুলিয়ার হুড়া থেকে কলকাতা। বাঁকুড়া থেকে হুগলীর সীমান্ত গোঘাটের কামারপুকুরের মধ্যে যখন পদযাত্রা প্রবেশ করছে তখন সব পাওয়ার এক রোমাঞ্চকর উন্মাদনা।

মানুষের ভীড়ে পদযাত্রীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে গোঘটে এসে পৌঁছালো পদযাত্রীরা। কামারপুকুর থেকে গোঘাট , ,আরামবাগ ,চাঁপাডাঙ্গা, চন্ডীতলা ,হাওড়া ছুঁয়ে কলকাতায় যখন মিছিলের অগ্রভাগ তখন তার শেষ ভাগ ছিল হাওড়া হুগলির সীমান্ত এলাকায় ।এই সুবিশাল মিছিল ও পদযাত্রা থেকে দাবি উঠেছিল ;– — *তারকেশ্বর থেকে বিষ্ণুপুর রেল লাইন করতে হবে, খেতমজুরদের মজুরি বাড়াতে হবে, গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ– সেচের সুব্যবস্থা করতে হবে, জমির কেন্দ্রীভবনকে ভেঙে উদ্বৃত্ত জমি, বৃহৎ জোতের মালিকের কাছ থেকে নিয়ে ভূমিহীনদের জমি দিয়ে পাট্টা দিতে হবে, পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নিবিড় করতে হবে। সকলের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা ও সব শিক্ষিত বেকারের হাতে কাজ চায়- এই ছিল তখনকার দাবি।আমি সহ আমরা কয়েকজন এই পদযাত্রায় শামিল হয়েছিলাম। হুড়া থেকে পদযাত্রা যখন কামারপুকুর হয়ে গোঘাটে এসে পৌঁছালো সে এক উচ্ছাস উন্মাদনার ভরা যৌবন। শ’য়ে শ’য়ে মানুষের অভ্যর্থনায় আগত পদযাত্রীরা উচ্ছসিত। সাময়িক বিশ্রাম, টিফিন চা। সেই উন্মাদনার মধ্যেই আমরা পদযাত্রীদের সঙ্গে কলকাতার উদ্দেশ্যে পা মেলালাম। হেঁটে হেঁটে কলকাতা যাচ্ছি কলকাতার উদ্দেশ্যে। রাস্তার দুপাশে রুক্ষ শুষ্ক জমি পড়ে আছে। বর্ষাকালের জলে কোনরকমে একটা ফসল হত। মাঠের পর মাঠ ধূ ধূ করছে। ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে চলেছি। এখনকার মতো এত গঞ্জ ছিল না। ফলে রাস্তার ধারে চা খাবার কোন উপায় ছিল না। ক্লান্ত ,ফোলা পা নিয়ে খু্ঁড়িয়ে খু্ঁড়িয়ে চলেছি পরবর্তী বিশ্রামের জায়গার দিকে। একফসলি জমি পড়ে আছে। ওই সকল জমির করুন অবস্থা আমার মতন বহু কৃষক দরদী ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের হৃদয়ে হাহাকার তুলেছে। সারা বছর চাষবাস না থাকায় কৃষক, খেতমজুরদের ঘরে ছিল অভাব।

তাই আমরা একসাথে গলা মিলিয়ে আওয়াজ তুলেছি গোঘাট  থেকে কলকাতা ভাই হেঁটে হেঁটে চলেছি, চাষবাসের জন্য সরকারের কাছে সেচ ও বিদ্যুৎ এর দাবি করেছি। রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা ও অর্থের দাবিও তুলেছি। মাশুল সমীকরণ নীতির পরিবর্তনের দাবিও আমরা কোরাস কণ্ঠে গলা মিলিয়ে তালি মারতে মারতে কলকাতার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছি। সেই ক্ষমতা- অর্থ দিয়ে আমরা সৃজনশীলতা মিশিয়ে আমাদের গ্রাম বাংলাকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা করে গড়ে তোলার শপথ  নিয়েছি আমরা। গ্রাম বাংলার উন্নয়নের সাথে সাথে বিদ্যুৎ, কয়লা ,নানান শিল্প তথা শ্রমিকদের সর্বাঙ্গীন উন্নতির লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মাসুল সমীকরণের নীতির পরিবর্তনের দাবি তুলেছি তেমনি কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের পুনর্ববিন্যাসের জন্য অন্যান্য রাজ্যগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান আমাদের শ্লোগানে মুখরিত হয়েছে পদযাত্রা। এই দাবীর স্বপক্ষে রাজ্যগুলিকে টেনে এনে আন্দোলন সংগঠিত করার নেতা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জননেতা জ্যোতি বসু।

তখনকার পদযাত্রা ছিল বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ।যে সরকারটা ছিল শ্রমিক কৃষক খেতমজুর ও শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থবাহী সরকার।সেই পদযাত্রার আঙ্গিক এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গ ছিল, বাংলার কৃষি -কৃষক, শিল্প শ্রমিক ও সার্বিক পরিকাঠামো বৃদ্ধিও কর্মসংস্থানের দাবিতে গড়ে ওঠা স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আওয়াজ তোলা মিছিল, যা শুধু এক একটি সাধারণ মিছিল নয়, বরং জনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণকন্ঠ থেকে উৎসারিত কল্লোল। যা ছিল এক কথায় বাংলাকে গড়ে তোলার এক অনবদ্য প্রয়াস।

আর এখন যে পদযাত্রায় আমরা মিলিত হচ্ছি,তাতে স্লোগান উঠছে–” চোর ধরো, জেল ভরো ,,”  “কত খেলে কত পেলে,”  “দুর্নীতিগ্রস্তদের মাথাদের অবিলম্বে বিচার চাই”  “গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই চলছে চলবে” এই রকম নেগেটিভ স্লোগান। এই মুহূর্তে বাংলাকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচানোই এখন আমাদের চরম লক্ষ্য। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলতে হচ্ছে স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত লুঠেরাদের কবল থেকে বাংলাকে উদ্ধার করতেই হবে। বাংলার ‘হৃত গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।’ অর্থাৎ দুই কালের পদযাত্রার মূলগত পার্থক্য তার আদর্শগত ও বৈশিষ্ট্যভিত্তিক  ভিন্নতা।

পশ্চিমবাংলায় সরকার পরিবর্তনের পর ২০১১ সাল থেকে বিশেষ করে গ্রামবাংলায় চরম সন্ত্রাসের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের। সংগঠন ও নেতৃত্ব কর্মীদের রক্ষা করার সংগ্রাম অব্যাহত রেখে  ধাপে ধাপে আমরা এগিয়েছি সংগঠনসহ মানুষের রুটি রোজগারের আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসের বিভৎসতার চূড়ান্ত অবস্থায় বিরোধীদেরকে সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার পরিবর্তে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার   উৎপীরনের খাঁড়া নেমে এসেছিল।  বহু মানুষকে ঘর ছাড়া, স্বজনহারা হতে হয়েছিল। তবু আমাদের আন্দোলন থেমে থাকে নি, বরং অত্যাচারীর প্রতি চোখে চোখ রেখে আজও আমরা শ্রমজীবি মানুষদের সংঘটিত লড়াই করে চলেছি।

২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে একালের পদযাত্রা গ্রামে গ্রামে সংঘটিত হচ্ছে। কলেবর হয়তো সেই কালের পদযাত্রার থেকে কম। কিন্তু ক্রমশ তার উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা যেন আবার ফিরে আসছে। দৃঢ়তার সঙ্গে আঁকাবাঁকা আলপথ ধরে লাল ঝাণ্ডার পদযাত্রা এগিয়ে চলেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এক বুথ থেকে পাশের বুথ।

গ্রামের মানুষ লাল ঝান্ডা দেখে ছুটে ছুটে আসছে, বলছে আবার লাল ঝাণ্ডার দল বেরিয়েছে, এবারে আমাদের কিছুটা সূরাহা হবে। তাদের চোখে মুখে ভীত সন্ত্রস্ত ভাব। তারা যেন কিছু বলতে চায়, কিছু নতুন করে ভাবতে চায়। তেমনি উপলব্ধি নিয়ে এগিয়ে গেলাম গ্রামের রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের দিকে। দূর থেকে হাত নেড়ে জানান দিচ্ছে আমরাও আছি।

ওইরকমই একদিন পদযাত্রায় হাঁটতে গিয়ে দূর থেকে মোহনদাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলাম। মোহনদাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,কি গো এবার তো বেরোতে হবে ! আর ঘরে বসে থাকলে হবে ? মোহন দা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত দিল। মিছিল থেকে দেখতে পেলাম একটা জটলা। এগিয়ে গেলাম। দেখি পুরনো দিনের সেই নাজেম চাচা। জিজ্ঞাসা করলাম কি হলো ? এগিয়ে এসে আমাকে কানে কানে বলল , আমাদের গ্রামে একদিন আসুন আমরাও পদযাত্রা করব। রাখঢ়াক-,গুড়গুড়ের দিন শেষ- এবার আমরাও পথে নামবো ,তাতে যা হবে হোক।নাজেম চাচার কথামত পরে একদিন নাজেম চাচার গ্রামে গিয়ে কৃষক সমিতির সদস্য সংগ্রহ শুরু করলাম। দু-চার জন থেকে আস্তে আস্তে ১৫ -২০ জনে দাঁড়ালো। সান্ধ্য বৈঠক সেরে পদযাত্রার তারিখ নির্দিষ্ট করা হলো। যা বুঝলাম তা হল জড়তা কাটছে, ভয় ভাঙছে, সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসছে সাধারণ মানুষ।এই সান্ধ্য বৈঠকের বিবরণ ও পদযাত্রার অভিজ্ঞতা পরবর্তী লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব । তবে বৈঠকটি ছিল খুবই শিক্ষণীয়, অভিজ্ঞতা অর্জনের সহায়ক। যা আগামী দিনে আমাদের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে।

০১।০১।২০২৩