![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image-30-1024x644.png)
সম্পূর্ণ ফুটবলারের প্রথম এবং এযাবৎ শেষতম উদাহরণ আজ ইতিহাসের অধ্যায়। দীর্ঘ রোগভোগের পর বিরাশি বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন ব্রাজিলকে তিনবার বিশ্বজয়ী করা কিংবদন্তি পেলে ওরফে এডসন অ্যারান্টোস ডো নাসিমন্টো। অবসর গ্রহণের পর কিছুদিনের জন্য ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে সতেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথমবার জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া এবং ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয় – নেহাতই সমাপতন ছিলনা।
সদ্য তরুণ পেলের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফুটবল বোদ্ধারা। তখন বিশ্বকাপের নাম ছিল জুলে রিমে কাপ। ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৭০ তিনবার ব্রাজিল এই কাপ জিতে নিজের দখলে রেখে দিয়েছিল। তিনবারই বিজয়ী দলের সদস্য ছিলেন পেলে। পাশে গ্যারিঞ্চা, ভাভা, ডিডি র মতো অসামান্য প্রতিভাধর ফুটবলারেরা থাকলেও প্রকৃত নেতার ভূমিকা ছিল পেলের। ১৯৬৬ সালে লণ্ডন বিশ্বকাপে ইউরোপীয় ফুটবলারদের বিশ্রী ট্যাকেলে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পরে বিরক্ত পেলে স্থির করেছিলেন অবসর নেবেন। কিন্তু ফুটবলপ্রেমীদের আবেগের মর্যাদা দিতে ফিরে এসেছিলেন জাতীয় দলে।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image-31.png)
আজকের বাজার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে কি ঘটত জানিনা, তবে ফুটবল সম্রাট পেলে কখনো ইউরোপের কোন ক্লাবে খেলেন নি। ফুটবলারজীবনের শেষ দুটো বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কসমস ক্লাবে খেলেছেন। এবং আমাদের কৈশোরে এই ক্লাবের হয়েই পেলে কলকাতায় মোহনবাগান ক্লাবের বিরুদ্ধে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে এসেছিলেন। ইডেন উদ্যানে অনুষ্ঠিত সেই খেলার ফলাফল ছিল ২-২ গোলে অমীমাংসিত। কাদা মাঠে স্বমহিমায় দেখা যায় নি ৩৭ বছর বয়সী বিশ্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে। কিন্তু সাকুল্যে গোটা ম্যাচে দু তিনটে টাচেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেন তিনি পেলে।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image-4.png)
সেই সময় মোহনবাগান ক্লাবের ফুটবল কোচ ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি পি কে ব্যানার্জী। আমাদের সুযোগ হয়েছিল বেশ কয়েকবার সেই স্বপ্নের ম্যাচের অভিজ্ঞতা শোনার। বার বার পি কে স্যার বলতেন সেই ম্যাচে পেলের পা থেকে আসা “ডেডলিফ কিক” এর কথা। বাতাসে ভাসা উঁচু বল আচমকা নিচে নেমে গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে দেয়।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image-8.png)
সেদিন মোহনবাগানের গোলরক্ষক শিবাজী ব্যানার্জীর ক্ষেত্রে অবশ্য একটু অন্যরকম ঘটনা ঘটে। কাদা মাঠে নন কিকিং ফুট বসে গিয়ে নিশানায় সামান্য হের ফের হওয়ায় পেলে গোল করতে পারেন নি। সেদিন অসাধারণ খেলেছিলেন শিবাজী ব্যানার্জী।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image.png)
পেলেকে তৈরি করেছিলেন ব্রাজিলের বিশেষজ্ঞ কোচ জোয়াও সালদানা। ব্রাজিলের শিল্প সম্মত ফুটবলের স্রষ্টা ছিলেন এই মানুষটি। যদিও জাতীয় দলের প্রাক্তনী ব্রিটো বাউরু অ্যাথেলেটিক ক্লাবের জুনিয়র দলে প্রশিক্ষণরত বালক পেলেকে আবিস্কার করেন। তাঁর চেষ্টাতেই পেলে মাত্র ষোল বছর বয়সে ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব স্যান্টোসে সুযোগ পান। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কখনও ক্লাব বদলান নি। ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ সতেরো বছর বয়সেই আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচ ব্রাজিল ২-১ গোলে হারলেও পেলে অভিষেক ম্যাচেই গোল করেছিলেন। তার পরেই সুইডেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ দলে সুযোগ এল। নেমেই প্রথম ম্যাচেই গোল করালেন ভাভাকে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। তারপরে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক। ফাইনালে নেমেছিলেন বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলার হিসাবে। পেলে একমাত্র ফুটবলার যিনি তিনটি ফাইনাল ম্যাচে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। শেষ বিশ্বকাপে মেক্সিকোতে টোস্টাও,জোয়ারজিনহো, রিভেলিনোদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সঙ্গে।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image-1.png)
ব্যক্তিগত দক্ষতার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন পেলের খেলা। দুই পায়ে সমান বল কন্ট্রোল ছিল। অবিশ্বাস্য গতি ছিল বল নিয়ে। প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে হাজার গোল করেছিলেন। দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ দুদিনের জন্য থামিয়ে রাখা হয়েছিল। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতা হলেও সুন্দর স্বাস্থ্যের কারণে ডিফেণ্ডারদের কড়া ট্যাকেলে সমস্যা হতো না। মার্কার লাগিয়ে তাঁকে আটকানো যেতো না। ত্রিশের বেশি বয়সে পেলেকে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ইতালির ব্যাক তারসিসিও বুর্গোনিচ। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন,এমন খেলা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image-2.png)
সমকালীন ফুটবলারদের মধ্যে ফেরেঙ্ক পুসকাস, অ্যালফ্রেড ডি স্টেফানো, ববি চার্লটন এবং জর্জ বেস্টদের সঙ্গে তুলনা হতো কিন্তু পরবর্তীকালে সবাই স্বীকার করেছেন পেলে একজনই। শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের শেষকথা ছিলেন তিনি। পেলে অবসর নেওয়ার পরে ব্রাজিলের ফুটবল জগত বার বার প্রতি বিশ্বকাপের আগে নতুন করে পেলে খুঁজত জিকো,রোনাল্ডো,রোমারিও,রোনাল্ডিনহো,রবিনহো, থেকে নেইমার পর্যন্ত প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের মধ্যে। কিন্তু এক্ষেত্রেও দেখা গেল পেলের বিকল্প পাওয়া যায়নি।
১৯৮৬ সালে দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা নামের বিস্ময় প্রতিভা আসার আগে পর্যন্ত পেলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে বিবেচিত হতেন। বাঁ পায়ের জাদুতে ও নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতায় পেলের মতো কমপ্লিট ফুটবলারের চ্যালেঞ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মারাদোনা।
![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/12/image-3.png)
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিওলেন মেসি এবং একেবারে কনিষ্ঠতম কিলিয়ান এমবাপে পর্যন্ত অন্তত পেলের সঙ্গে তুলনায় এই চ্যালেঞ্জার হিসেবেই পরিগণিত হবেন। পেলের জীবনাবসান নিঃসন্দেহে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান। কিন্তু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসাবে তাঁর নাম চিরভাস্বর থাকবে।