মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নবান্নে যাচ্ছেন না। বাড়ি থেকে বেরচ্ছেন না। চারদিন আগে এই নিভৃতবাস শুরু মুখ্যমন্ত্রীর, এমনই জানা যাচ্ছে নবান্ন সূত্রে।

তবে দলের নাম তৃণমূল। রাজ্য যখন সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে জেলায় জেলায়। প্রার্থীপদ জমা দিতে কাণ্ডজ্ঞানহীন তৃণমূল নেতারা জমায়েত করেছেন, মিছিল করেছেন। রীতিমতো নাচছেন। শাসক দলের এই জ্ঞানগম্যিহীনতার খেসারত দিচ্ছেন রাজ্যবাসী।

মঙ্গলবার জানা গিয়েছে, নবান্নে যাচ্ছেন না মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীও। এমনটাই নবান্ন সূত্রে খবর। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিবেরই এই হাল, রাজ্যবাসী কী অবস্থায় আছেন। এক কথায় — বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ। সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র ‘পজিটিভ’ হলে তা প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পারেন তিনি এবং পার্টি। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জনস্বাস্থ্য, মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধের প্রশ্ন। কিন্তু নবান্নের ১৪ তলায় বসে যিনি রাজ্য শাসন করছেন, তাঁর পক্ষ থেকে কেউ তাঁর নিভৃতবাস নিয়ে একটি মন্তব্য করার সাহস দেখাচ্ছেন না। মঙ্গলবার কয়েকজন মন্ত্রী, আমলাকে ফোন করা হয়েছিল। কেউই এক লাইন বলার সাহস দেখাননি।

তবে বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান ব্যানার্জি যা বলেছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি আইসোলেশনে? তিনি বলেন,‘‘কেন? আমি তো আজও বিধানসভায় গেছিলাম। শুভেন্দু অধিকারীর চারটি কেসের হিয়ারিং ছিল।’’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব নবান্নে যাচ্ছেন না বর্ষবরণের রাতের পর থেকে। আইসোলেশনে আছেন বলে মনে হচ্ছে। তেমনই জানা যাচ্ছে। অধ্যক্ষ বলেন,‘‘কেন? মুখ্যসচিবের সঙ্গে তো আজই ফোনে কথা হলো। আমার মনে হয় তিনি আইসোলেশনে নেই।’’ সযত্নে মুখ্যমন্ত্রীর প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। বললেন,‘‘আমি জানি না।’’ মুখ্যমন্ত্রীর খবর রাখছেন না বিধানসভার অধ্যক্ষ। 

এই নিভৃতবাস গোপন রাখার পিছনে আর একটি কারণ আছে। মুখ্যমন্ত্রী লোকলস্কর নিয়ে সাগরে প্রশাসনিক বৈঠক করেছিলেন। ফিরে এসে ৩১ ডিসেম্বর বর্ষশেষের আনন্দ অনুষ্ঠানে ছিলেন। রাজ্যের মানুষ বাঁধ ভাঙা উল্লাস নিয়ে বর্ষশেষের ভিড়ে, আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস পেয়েছিলেন। ফল হয়েছে ভয়ঙ্কর। গত শনিবার, ১ জানুয়ারি করোনা সংক্রমণ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বিদ্যুৎ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। প্রশাসনের অনেকের মতে এরপরই মুখ্যমন্ত্রী নিভৃতবাসে চলে যান। তিনি কি করোনা পজিটিভ? পরীক্ষা হয়েছে? গোপন রাখা হয়েছে সব তথ্য।

মুখ্যমন্ত্রী নিভৃতবাস গোপন রাখা হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যের মানুষের সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। তা আর গোপন রাখা যাচ্ছে না পুরোপুরি।

প্রমাণ? সরকারি তথ্য।

করোনায় পশ্চিমবঙ্গের দুরবস্থা তথ্যে স্পষ্ট। সরকারের  করোনা পজিটিভের হার কত? পরীক্ষা চালিয়েছিল রাজ্য সরকারগুলি। সেই রিপোর্টে শীর্ষে দেশের ১৭টি জেলা। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেরই ৫টি। 

গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি — এই এক সপ্তাহের রিপোর্ট পৌঁছেছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরেও। স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সপ্তাহে করোনা পরীক্ষার পর পজিটিভ হয়েছে ১০% কিংবা তার বেশি এমন ওই ১৭টি জেলার মধ্যে শীর্ষে হিমাচল প্রদেশের লাহুল-স্পিতি জেলা। সেখানে পজিটিভির হার ৬৩.৬৪%। দ্বিতীয় স্থানেই কলকাতা। এখানে পজিটিভির হার ৩৮.৩৭%। দেশে দ্বিতীয় স্থানে হাওড়া। এখানে পজিটিভির হার ২২.৩০%। রাজ্যের বাকি তিনটি ‘বিপজ্জনক’ জেলা পশ্চিম বর্ধমান (১২.৬৬%), উত্তর ২৪ পরগনা (১০.৬৫%) এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা (১০.১৮%)।

দেশে পরীক্ষা করে ৫% থেকে ১০%-র মধ্যে পজিটিভ মিলেছে ৩৫টি জেলায়। তার মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গের ৩টি জেলা আছে — বীরভূম, হুগলী, মালদহ। তাছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বাকি ১৫টি জেলাতেও ‘পজিটিভ’ মিলেছে, পরীক্ষার ৫%-র কম। কিন্তু আছে।

অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় গত সপ্তাহেই করোনা পজিটিভ মিলেছে। 

পশ্চিমবঙ্গে করোনা আবহের গোড়া থেকেই পরীক্ষায় রাশ টেনেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। মূলত ‘পজিটিভ’ কম দেখানোর জন্যই পরীক্ষা কম করা হয়েছে রাজ্যে। এখনও তাই চলছে বলে অভিযোগ।

মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাবও ছিল ঢিলেঢালা। গত বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর সাগরদ্বীপ থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন,‘‘এখনই কিছু বন্ধ হচ্ছে না। পরিস্থিতি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আরও বলেছিলেন,‘‘বর্ষবরণের উৎসব আটকাবো কী করে? তবে আমরা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের উপর নজর রাখছি।’’ কেমন নজর রেখেছিল প্রশাসন, তার প্রমাণ মিলেছিলেন রাস্তায় উপচে পড়া ভিড়ের সামনে পুলিশের দাঁড়িয়ে থাকা দেখে।

মুখ্যমন্ত্রী সাগর থেকে ফেরার পরই সরকারের বিধি নিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত — ২ জানুয়ারি। স্কুল বন্ধ, পানশালা খোলা। নাইট কারফিউ জারি হয়েছে। আরও কিছু বিধি নিষেধ জারি। 

কলকাতার হাল খারাপ — তার প্রমাণ কলকাতা কর্পোরেশন। মেয়র হিসাবে ফিরহাদ হাকিমের শপথ অনুষ্ঠানের পরেই করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে তৃণমূলের বিধায়ক তাপস রায়, তাঁর স্ত্রীর, ৩৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাধনা বসুর। মেয়রের অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটরও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার অভিষেক ব্যানার্জির বাধা সত্ত্বেও দলনেত্রীর কৃপায় ফিরহাদ হাকিমের মেয়র ‘অভিষেক’র অনুষ্ঠানে তাঁর অনেক সমর্থক ভিড় করেছিলেন অনুষ্ঠানে। করোনা বিধি মানাও হয়নি, অভিযোগ এমনই। মঙ্গলবার আর এক কাউন্সিলর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

কিন্তু মেয়রের অবস্থান কী? তিনি নিভৃতবাসে যাননি। এখনও করোনা পরীক্ষা করেননি। আশঙ্কা নিয়েও বৈঠক করছেন কর্পোরেশনে।