ভোটগ্রহণের দিন যত এগিয়ে আসছে, ২০১৫ সালের ভয়ানক স্মৃতি ততই ফিরে আসছে বিধাননগরবাসীর মনে। রক্ত ঝরিয়ে ভোট লুট করা তৃণমূলকে শাস্তি দিতে এবার সাহসের সঙ্গে বুথে গিয়ে ‘নিজের ভোট নিজে দিন’ এই আবেদন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বামফ্রন্ট কর্মীরা। ইতিমধ্যেই বিধাননগরের পুলিশ ও মহকুমা প্রশাসনের কাছে একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়ে এবারের পৌর নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার দাবি জানিয়েছেন বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। প্রশাসনের আশ্বাস, ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনের কথা বাদ দিন, তারপরে যে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন হয়েছে তখন তো আর ওইরকম হিংসাত্মক কার্যকলাপ ঘটেনি। এবারও ঘটবে না। অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসনের কর্তারাও সর্বশেষ বিধাননগর পৌর নির্বাচনের সন্ত্রাসকে অস্বীকার না করে ‘কলঙ্ক’ বলে মেনে নিচ্ছেন। শুধু পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ শুধু মৌখিক আশ্বাসে সন্তুষ্ট নন। সিপিআই(এম) নেতা পলাশ দাশ বলেছেন, লোকসভা আর বিধানসভার নির্বাচন তো হয়েছে ভারতের নির্বাচন কমিশনের অধীনে। বিধাননগরের যে পৌর নির্বাচন রক্তাক্ত সন্ত্রাসের মধ্যে ঘটেছিল, সেটা ছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে। এবারও তাদের পরিচালনাতেই বিধাননগর পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচন হচ্ছে। কাজেই মানুষের আশঙ্কা অমূলক বা অযৌক্তিক হতে যাবে কেন! কী ঘটেছিল ২০১৫ সালের ৪ অক্টোবর? সেদিন বিধাননগর পৌর নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলাকালীন তৃণমূলের বহিরাগত বাহিনীর সন্ত্রাসে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিধায়ক সুজিত বসু, পরেশ পাল সহ নেতারা যাঁরা কেউ বিধাননগরের ভোটারই নন।

বুথে বুথে ঢুকে বামফ্রন্ট এজেন্টদের মেরে রক্তাক্ত করে বের করে দেওয়া, নাছোড় ভোটারদের মারধর করে তাড়ানো এসব তো ছিলই। তার সঙ্গে হিংসাত্মক ভোটলুটের ছবি তুলতে যাওয়া সাংবাদিকদের জন্য ছিল বীভৎস মারধর। এমনকি মহিলা সাংবাদিকরাও রেহাই পাননি সেদিনের আক্রমণ থেকে। পুলিশের সামনে মহিলা সাংবাদিকদের ‘রেপ’ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর চলে যেতে বলা হয়েছে ঘটনাস্থল থেকে। দাপিয়ে বেড়িয়েছিল সেই বাহিনী যাদের সল্টলেকের বিভিন্ন গেস্ট হাউসে এবং আশপাশের নানা আশ্রয়ে আগের দিন তুলে এনে রাখা হয়েছিল। শুধু বিধাননগরেই ১৭ জন সাংবাদিক আক্রান্ত ও আহত হয়েছিলেন সেদিন। প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর স্ত্রী রমলা চক্রবর্তী প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁর বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূলের বাহিনী। সেখানেও উপস্থিত সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাঁশ দিয়ে, পাথর ছুঁড়ে সাংবাদিকদের রক্তাক্ত করা হয়েছে।

নাক মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে, এই অবস্থায় সাংবাদিকরা ক্যামেরার সামনে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, তৃণমূল নেতা এবং পুলিশের উপস্থিতিতে দুষ্কৃতীবাহিনী কীভাবে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। আহত কয়েকজন সাংবাদিককে কলকাতায় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। সাংবাদিকরা ক্যামেরাবন্দি দুষ্কৃতীদের ছবি দেখে দেখে পরদিন কয়েকজনের পরিচয়ও খুঁজে বের করেছিলেন। পরদিন আনন্দবাজার পত্রিকার শীর্ষ সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘মুখ ঢাকো লজ্জায়’। সংবাদে লেখা হয়েছিল, ‘ভোট করালো ভজাইরা, পাহারা দিল পুলিশই’। দৈনিক স্টেটসম্যানের শিরোনাম ছিল ‘মিনি ভোট, ম্যাক্সি সন্ত্রাস’। এই সময় পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘অবাধ লুম্পেনরাজ’। দ্য টেলিগ্রাফের শিরোনাম ছিল, ‘হাইড, দিদি, হাইড’। প্রতিদিন পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘দাপটের ভোট শাসকের’। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এমন ঘটনার পরেও দুষ্কৃতীদের ভোটলুটের তাণ্ডবের কোনও নিন্দা করেনি।

সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বিধাননগরের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে কমিশনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘কমিশন চোখে মাস্ক পরে বসে আছে। মানুষ কিন্তু আর ভোটলুট বরদাস্ত করবে না।’ বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যেই অভিযোগ করেছেন, বামফ্রন্ট প্রার্থীদের প্রচারে বাধা, ফেস্টুন ছিঁড়ে দেওয়া, প্রচারসভার মাইকের তার ছিঁড়ে দেওয়া, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি এসব এবারও চলছে। নির্বাচনী প্রচারেই যদি এসব হয়, তাহলে ভোটের দিন এই শাসকদল ভোটলুট করতে আবার সচেষ্ট হবে এমন আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। পলাশ দাশ বলেছেন, তৃণমূলের প্রার্থীরা বিধাননগর কর্পোরেশনের কাউন্সিলর পদে জেতার জন্য মরিয়া এবং বেপরোয়া। কারণ ওদের কাছে কর্পোরেশনটা উন্নয়নের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টার। জনগণকে লুটে কোটি কোটি টাকা কামানোর এই সুযোগ ধরে রাখতে ওরা মানুষের অধিকারে এতটুকুও বিশ্বাস করে না।

Source- Ganashakti