গণতন্ত্র রক্ষা ও রাজ্যে সন্ত্রাস মোকাবিলায় দৃঢ় লড়াই চালানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬ তম সম্মেলন। সম্মেলনে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসাবে। এই তিনটি ধারণাই পারস্পরিক সম্পর্কিত। একটি দুর্বল হলে অন্যগুলি দুর্বল হতে বাধ্য। গণতন্ত্রের নানান ধারণার মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের অগ্রগতি ও বিকাশের পথ হিসাবে চিহ্নিত করে দীর্ঘ প্রায় দুই বৎসরাধিক কাল কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা ও বিতর্কের পর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান দেশের গণতন্ত্রের রূপরেখা ও পথপ্রদর্শক হিসাবে গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পরবর্তী সময় নানা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংবিধানে অসংখ্যবার বিভিন্ন ধরনের সংশোধন ঘটেছে এবং সংসদে আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে সংবিধানের তিনটি মূল স্তম্ভ আইনসভা, বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসন নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ ও পরিস্থিতির সুযোগ পেয়েছে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে ভারতীয় গণতন্ত্র প্রথম বড় ধরনের আক্রমণের মুখে পড়ে। গণআন্দোলন এবং জনতার জাগরণের মধ্য দিয়ে এই আক্রমণকে পরাস্ত করা যায়। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আরএসএস-বিজেপি শাসন ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় সাধারণতন্ত্রকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার মূল এজেন্ডাকে প্রকাশ্য এবং তীব্র করে। ফলে ভারতীয় গণতন্ত্র গুরুতর আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়েছে। আইনসভা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম — প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে আরএসএস-বিজেপি’র নেতৃত্বে দখল করার কার্যক্রম চলছে। মানুষের মৌলিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিনিয়ত আক্রান্ত। ভারতীয় সংবিধানে বিরোধী দলের ও মতের যে ভূমিকা স্বীকৃত আছে তাকে শুধু নস্যাৎ করাই নয়, যে কোনও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য জেল, জরিমানা, খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে। বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, লেখক, চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা থেকে সাধারণ মানুষ — কেউ এই আক্রমণের হাত থেকে বাদ নেই। বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এককথায় এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে মোদীর রাজত্বে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গেরুয়াকরণ চলছে। ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। চলচ্চিত্র আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি সঙ্ঘ পরিবারের দর্শনের পরিপন্থী কোনও চলচ্চিত্র তৈরি হলে তার শো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, পরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ‘গোরক্ষক’ নামে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী নিরপরাধ সংখ্যালঘু মুসলমানকে খুন করার পরেও শাস্তি তো দূরের কথা, তারা পুরস্কৃত হচ্ছে। সাংসদরাও সংসদে স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারছেন না, নির্বাচন কমিশনকে পুরোদমে নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে, যা শুধু গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার অভিযান নয়, ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এর পাশাপাশি আমাদের রাজ্যেও তৃণমূল সরকার গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিতে ২০১১ সাল থেকেই প্রধান হাতিয়ার করেছে সন্ত্রাসকে। লুটেরা পুঁজির সাথে মেলবন্ধন ঘটিয়ে বর্তমানে এই শক্তি আরও আগ্রাসী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। আমলাতন্ত্র এবং পুলিশকে নিজেদের দলদাসে পরিণত করেছে। রাজ্যের নির্বাচন কমিশন সহ প্রায় সকল প্রচারমাধ্যমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে এই কাজ করছে। বিচার ব্যবস্থাও বাদ নেই। রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চলছে একটানা সন্ত্রাস।

এখন একটু কায়দা, কৌশল পরিবর্তন করেছে। সারা বছর বামপন্থীদের কর্মসূচির ওপর লাগাতার হামলা হয় না, কিন্তু নির্বাচনকে পুরোমাত্রায় প্রহসনে পরিণত করা হচ্ছে পুলিশ, প্রশাসন এবং তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের দ্বারা। এখানেও মুখ্যমন্ত্রী ও তার দল প্রথম থেকেই আক্রমণের মূল টার্গেট করেছে বামপন্থীদের। আরএসএস-বিজেপি’র সাথে বোঝাপড়া করে এই কাজ চলছে। পঞ্চায়েত ও পৌরসভার সরকারি অর্থ লুট এবং প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তোলাবাজির জন্য প্রতিটি এলাকায় এলাকায় তৈরি হয়েছে গুন্ডাবাহিনী। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তৃণমূলের জমানায় এই ১১ বছরে সন্ত্রাসে শতাধিক বামপন্থী নেতা ও কর্মী খুন হওয়া, হাজার হাজার কর্মীর বহুদিন ঘরছাড়া থাকা, অজস্র নেতা-কর্মীদের জেল, জরিমানা, মিথ্যা মামলার পরও সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করে পার্টি ও বামপন্থীদের এগিয়ে যাওয়ার লড়াইও অব্যাহত আছে। এক মুহূর্তের জন্যও স্তব্ধ করা যায়নি। যেমন দেশে বিজেপি-আরএসএস-এর অন্যতম প্রধান টার্গেট কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা, তাই তিন রাজ্যে বিজেপি জেতার পর ত্রিপুরার কমিউনিস্ট পার্টির ওপর আক্রমণ নেমে আসে, একইরকমভাবে কোনও আক্রমণই আরএসএস-বিজেপি’র গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লড়াই আন্দোলন এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলগুলির গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এবং সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে এই রাজ্যে প্রয়োজন বিজেপি-তৃণমূল বি‍‌রোধী সকল ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য। সমস্ত গণতান্ত্রিক ও শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে গণতন্ত্র রক্ষা এবং সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করাই হলো এই সময়ে বামপন্থী ও সিপিআই(এম) কর্মীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলন সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য সমস্ত পার্টিকর্মীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।

সুত্র- গণশক্তি