কলকাতায় রমরমিয়ে চলছে জাল কোভিশিল্ডের কারবার। স্পষ্ট জানিয়ে দিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। হু’র মুখপাত্র তারিক জাসারেভিচ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘কলকাতায় ভুয়ো কোভিশিল্ড টিকা রয়েছে। এই মর্মেই খবর এসেছে হু-এর কাছে। তবে কোন সূত্রে এ খবর মিলেছে তা প্রকাশ করবে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।’

জুলাই-আগস্ট জুড়ে কোভিশিল্ড সংক্রান্ত বিভিন্ন সূত্র থেকে নানা রিপোর্ট জমা পড়েছে হু’র দপ্তরে। সেই অনুযায়ী সতর্কবার্তা জারি করে একটি তালিকা বানিয়েছে হু। কোভিশিল্ড নির্মাতা সেরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, হু’র ওই তালিকায় যা রয়েছে তা সত্যিই জাল। অর্থাৎ ‘পেশেন্ট লেভেল’-এ বা রোগীদের দেওয়া হয়ে গেছে এমন অনেক কোভিশিল্ড আদৌ আসল ভ্যাকসিন নয়। সেগুলিতে আসল ভ্যাকসিনের কোনও উপাদান নেই। যেমন ২এমএল কোভিশিল্ড পাওয়া গেছে যা থেকে প্রমাণিত এই মাত্রার ভ্যাকসিনের ভায়াল জাল। কারণ ২এমএল’র কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন সেরাম ইনস্টিটিউট তৈরি করে না । এছাড়াও খবরে প্রকাশ, একটি ব্যাচ নম্বর ৪১২১ জেড ০৪০ শনাক্ত করা হয়েছে যার মেয়াদ কাল বা ১০-৮-২০২১।          

হু’র এমন বক্তব্য প্রকাশ্যে আসার পর সরকারি-বেসরকারি স্তরে দেওয়া কোভিশিল্ড টিকা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেছেন সাধারণ টিকা গ্রহীতারা। কারা তাহলে নকল ভ্যাকসিন তৈরি করছে, কীভাবে সেগুলি বাজারে পৌঁছাচ্ছে আর টিকা গ্রহীতাদেরই বা দেওয়া হচ্ছে কোন পথে। হু’র মুখপাত্র তারিক জাসারেভিচের ওই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের নজরদারি শুরু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গোপনে সূত্রের সামান্য আভাস দিলে ওই ধরনের জালিয়াতিদের সহজে খোঁজ পাওয়া যেত। তাই এক্ষেত্রে হু’র কাছে কলকাতা পুলিশের তরফে অনুরোধ জানানো হবে। এখন কোভিশিল্ড বেসরকারি ক্ষেত্রেও সহজে মিলছে। আগে সরকার থেকে কিনতে হতো বেসরকারি সংস্থাকে। এখন তারা সরাসরি কিনছে বলে জানা যাচ্ছে। সরকারি ক্ষেত্র নাকি বেসরকারি ক্ষেত্র- কোন পর্যায়ে জাল ভ্যাকসিনের কারবার চলছে-তা নিয়ে এখন উঠছে প্রশ্ন। 

আর সেখানেই হয়ত কোনও সমস্যা হতে পারে। চাহিদার ফায়দা তুলেই জালিয়াতরা কোভিশিল্ড টিকা জাল করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিস্তারিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ওয়েস্টবেঙ্গল মেডিক্যাল অ্যান্ড সেলস রেপ্রেজেন্টেটিভ ইউনিয়নের নেতা সুমহান চক্রবর্তীর বক্তব্য, কোভিশিল্ড টিকা যে জাল হচ্ছে তা হু’র বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারছি। এখন দেখতে হবে কীভাবে এই কাজ চলছে। ঘটনার প্রকৃত তদন্ত চাই। সাধারণ মানুষের সামনে বিস্তারিতভাবে আসা দরকার। ভ্যাকসিনের বদলে কী তরল পদার্থ দেওয়া হলো মানুষকে— সেটাও জানাতে হবে পরিষ্কার করে। একই বক্তব্য অল ইন্ডিয়া কেমিস্ট অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটরস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জয়দীপ সরকারের। তিনি বলেন, সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রগুলির টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু আলাদা সিস্টেম কাজ কাজ করছে। কারা কীভাবে টিকা পাচ্ছেন, কীভাবে কিনছেন তা পরিষ্কার করে জানতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। জানা বোঝার এই ফাঁকের সুযোগ নিয়ে জাল জুয়াচুরি অসম্ভব কিছু নয়। বাস্তবে কী ঘটছে তা সাধারণ মানুষকে পরিষ্কার করে জানানো দরকার।    

দু’মাস আগেই দক্ষিণ কলকাতায় কসবায় টিকা নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা সামনে এসেছিল। শুধু কলকাতা নয়, মুম্বাই, দিল্লিতে একাধিকবার  ভুয়ো টিকা প্রয়োগের দায়ে জালিয়াতদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কলকাতায় টিকাকাণ্ডের পান্ডা দেবাঞ্জন দেবের মতো জালিয়াত ধরা পড়ার পর পুলিশ প্রশাসন  নজরদারি নাকি বহুগুণ বাড়িয়েছে। তাহলে কী করে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে জাল কোভিশিল্ড দেওয়া হচ্ছে? 

কসবা ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারি কাণ্ডে কলকাতা হাইকোর্টে যে রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন, স্পুটনিক— কোনও কিছুই দেওয়া হয়নি কসবার শিবিরে। বরং কোভিশিল্ড, স্পুটনিকের লেবেল লাগানো থাকতো ভায়ালে। ভায়ালে ছিল অ্যামিকাসিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক। ছিল ট্রায়ামলিনোলোম অ্যাসিটোনাইড। এটি সাধারণভাবে স্টেরয়েড হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শরীরে গেলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ফরেন্সিক রিপোর্টকে ভিত্তি করেই এমন দাবি করেছিল পুলিশ। সবকিছুই হয়েছে কিন্তু এখনো ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হয়নি। অনেক দিকই অন্ধকারে থেকে গেছে।   

ভুয়ো টিকার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে মঙ্গলবার বিশেষ মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রকাশ করেছে হু। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, টাকার বিনিময়ে এখন সরাসরি রোগীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে কোভিশিল্ড। যদিও এখনও দোকানে বা খোলা বাজারে সেই টিকা ছাড়া হয়নি। প্রাইভেটে টিকা মিললেও তা দেওয়া হচ্ছে হাসপাতাল বা বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে। কোভিশিল্ড প্রস্তুতকারক সংস্থা সেরাম ইনস্টিটিউটও জানিয়েছে সরাসরি রোগীদের তারা টিকা বিক্রি করছে না। তাহলে এখানেই প্রশ্ন যে হাতে হাতে টিকার জোগান মিলছে কীভাবে? এই রিপোর্ট প্রকাশের পরই ভারতকে ভুয়ো টিকার বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে বিষয়টি রাজ্য সরকারকে বুধবার জানানো হয়েছে। পুরো ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে প্রস্তুতকারক সেরাম ইনস্টিটিউটকে। 

Source- Ganashakti