তৃণমূলের সর্বগ্রাসী খিদের পরিণামে কলকাতা যেন হয়ে উঠছে যেন এক ‘মৃত্যুপুরী’। টাকার খিদে। পরিবেশ থেকে জলাশয়, বাদ যাচ্ছে না কিছুই। কাশীপুর, বেলাগাছিয়া থেকে তপসিয়া, তিলজলা, যাদবপুর থেকে বেহালা, ডায়মন্ডহারবার রোড— শাসক তৃণমূলের সিন্ডিকেট বাহিনীর রমরমা। এলাকাভিত্তিক শাসক দলের দাপটের ভরকেন্দ্রে সিন্ডিকেট রাজ। শহরের যে কোনও প্রান্তে যে কোনও নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে ‘অনুপ্রেরণা’র রেট। উত্তর থেকে মধ্য হয়ে দক্ষিণ— এলাকা ভিত্তিক বদলে যায় বর্গফুট পিছু তোলাবাজির রেটও। প্রোমোটিং কারবারে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি অনায়াসে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকাতেও। কাঁচা টাকার সেই লোভেই এখন রীতিমতো সঙ্কটের মুখে তিলোত্তমার অস্তিত্ব। বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের দিনই ডিজিটাল ইশ্‌তেহার প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে শহরের এগিয়ে চলার স্বার্থেই চিরায়ত দাবির পাশে নিছক পৌর পরিষেবার গণ্ডি ছাড়িয়েই মহানগরের উন্নয়নের নতুন আঙ্গিকের ভাবনার প্রকাশ পেয়েছে। অভিমুখকে সামনে রেখেই গ্রাফিক্সে ১৫ দফা অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার ও ভাবনার আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটকে শহরবাসীর সামনে তুলে ধরতে ডিজিটালের পাশাপাশি ছাপা অক্ষরে কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের ইশ্‌তেহার প্রকাশিত হতে চলেছে। সেখানেই স্পষ্ট অভিযোগ— কাটমানির প্রকল্পে আলো হচ্ছে রাস্তায়। আর কালো হচ্ছে বাতাস। গোটা দুনিয়ার দূষিত শহরের মধ্যে প্রথম সারিতে আছে কলকাতা। দশ বছরে প্রয় পঞ্চাশ হাজার গাছ কাটা হয়েছে এই শহরে। ভরাট করা হয়েছে প্রায় হাজারের বেশি জলাশয়। সেই জমিতেই তৈরি হচ্ছে বহুতল, বেআইনিভাবে। আর এই বেআইনি নির্মাণের বেআইনি টাকাতেই ভোটে লড়বে তৃণমূল’। শহরাসীর অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ইশ্‌তেহারের পাতায়।

পরিবেশ আন্দোলনকারীদের দাবি, ২০০৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা শহরে প্রায় ৭২০০টি জলাশয় ছিল। তৃণমূল বোর্ড বার কলকাতা কর্পোরেশনে আসে ২০১০ সালে। ২০১৭ সালের মধ্যেই সেই জলাশয়ের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩৯০০। গত চার বছরে তা কমেছে আরও। তৃণমূলের ১১ বছরের সময়কালে কলকাতায় চার হাজারের মতো জলাশয় বুঁজে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বেশ কয়েক বছরে যথেচ্ছভাবে বুঁজিয়ে ফেলা হয়েছে। জলাভূমির প্রায় ৪০ শতাংশ ইতিমধ্যে বুঁজিয়ে ফেলা হয়েছে। অবৈধ নির্মাণ। প্রতিটি ঘটনাতেই অভিযুক্ত শাসক দল। ফলে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা অভিযোগ জানালেও পুলিশ নীরব। দীর্ঘদিন মেয়র ও প্রশাসক পদ সামলানো ফিরহাদ হাকিম যদিও একাধিকবার এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ভরাট হয়েছে এমন অভিযোগ আসেনি কর্পোরেশনের কাছে। শাসক দল-সিন্ডিকেট-প্রোমোটিং চক্র এবং পুলিশ প্রশাসন তো একসূত্রেই গাঁথা। গত কয়েক বছরে আমফান থেকে ইয়াস, একাধিক কালবৈশাখীতে এই শহরের প্রায় ২০ হাজার গাছ পড়ে গিয়েছে। একইসঙ্গে বেআইনি নির্মাণ, শহরের সৌন্দর্যায়ন, রাস্তা প্রশস্ত করার তড়িঘড়ি পরিকল্পনায় হাজার হাজার গাছ কাটা পড়েছে। কোথাও শাসক তৃণমূলের জমি দখল, অবৈধ নির্মাণ কারবারের জন্যও গাছ কাটা পড়েছে। সব মিলিয়ে সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। কলকাতার পরিবেশ বিপন্ন। ‘বেআইনি নির্মাণের কারণের জলাশয় কমে আসছে। এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, এই গতিতে চললে আগামী দশ বছর পরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই শহরের সব জলাশয়। পরিবেশবিদরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, কলকাতা হয়ে উঠতে চলেছে সাইক্লোনের রাজধানী। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। কলকাতা হয়ে উঠছে যেন এক মৃত্যুপুরী’— ইশ্‌তেহারের পাশাপাশি কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের প্রচারপত্রেও শহরবাসীর আশঙ্কা অনুবাদ হয়েছে এমনভাবেই। ‘বস্তি রেখেই বস্তির উন্নয়ন’ তৃণমূল পৌরবোর্ডের আমলে তা এখন বাতিল হয়ে যাওয়া ধারণা। বরং ঠিকা প্রজাসত্ত্ব আইন সংশোধনে কয়েক লক্ষ বস্তি উচ্ছেদের শঙ্কায়।

মডেল বস্তির সাইবোর্ড টাঙানো আছে। অথচ বেলগাছিয়া থেকে হাটগাছিয়া বস্তি— দু’পা হাঁটলেই ভয়াবহ জীবন যন্ত্রণার ছবি। পৌর বাজেটে কমেছে বস্তির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ। বস্তির নিকাশি নেই বরাদ্দ। জেলা বামফ্রন্টের ইশ্‌তেহারে তাই স্পষ্ট অভিযোগ— ‘কলকাতা বাড়ছে আকাশের দিকে। বস্তির দখল নিচ্ছে প্রোমোটার। শহরে ঠাঁই হচ্ছে না গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের’। ১৪৩টি বাংলা মিডিয়াম স্কুল, ১০৪টি হিন্দি মিডিয়াম স্কুল, ৫৮টি উর্দু স্কুল সহ বস্তিতে কলকাতা কর্পোরেশনের পরিচালিত স্কুলগুলিতে গত ১১ বছর ধরে নতুন কোনও শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। বরং স্কুল বাড়ি ব্যবহার হচ্ছে শাসক দলের অনুষ্ঠানের জন্য, কোথাও আবার প্রোমোটিংয়ের নকশা। অজান্তেই শহরের বস্তিবাসী শিশুরা শিক্ষাজ্ঞান থেকে ছিটকে যাচ্ছে। এই শহর থেকে আসলে ছিটকে যাচ্ছে গরিব মানুষই। বিত্তবানদের জন্য সৌন্দার্যয়নও অগ্রাধিক শাসক তৃণমূলের উন্নয়ন পরিকল্পনায়। ইশ্‌তাহারে ছাপার অক্ষরে ঘোষিত বামফ্রন্টের দায়বদ্ধতা— বস্তি অঞ্চলে প্রতিজন স্কুলছুটদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করারর জন্য বাড়িতে বাড়িতে বিশেষ কর্মসূচি। বস্তিতে বস্তিতে গড়ে তোলা হবে কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার। কর্পোরেশনে ২৮ হাজার শূন্যপদ। নিয়োগ নেই। বাড়ছে ঠিকা, চুক্তিভিত্তিক কর্মী। শহরে কাজের আকাল। চটকদারির রঙচঙে ‘উন্নয়নে’ মেতেছে শাসক দল। দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক স্পষ্ট। সেই ফারাককে আরও বিস্তৃত করেই বামফ্রন্টের ইশ্‌তেহারে এই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি। তৈরি করা হবে লিঙ্গ নিরপেক্ষ শৌচালয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা হবে। তাঁদের সমস্ত ধরনের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। কর্পোরেশনের চিরায়ত গণ্ডির বাইরে সামগ্রিক উন্নয়নের দায়বদ্ধতার ছবি তুলে ধরেছে ইশ্‌তেহারে। শহরের ১৪৪টি ওয়ার্ডের মানুষের কাছে বামফ্রন্ট কর্মীরা পৌঁছাবে সেই দায়বদ্ধতার নথি হাতেই। একইসঙ্গে বিভাজনের রাজনীতিকে এতটুকুও মাথা তুলতে না দেওয়ার অঙ্গীকার। জেলা বামফ্রন্টের প্রচারপত্রে শহরবাসীর কাছে তাই প্রশ্ন ছুঁড়েছে— এই শহরে দেশপ্রাণ শাসমল ছুঁয়ে থাকেন আনোয়ার শাহকে। সূর্য সেন মিশে যান ছক্কু খানসামাতে। রতনবাবুও নিশ্চিন্তে থাকেন রুস্তমজীর সংস্পর্শে। দাঙ্গাবাজরা দু’পায়ে দলবে এই শহরের তাবৎ ঐতিহ্যকে— মেনে নেবেন আপনি?

Source- Ganashakti