‘‘আমি বিচারাধীন। কিছুদিন আগেও বন্দি ছিলাম। আমার এই বিষয়ে কিছু বলা উচিত নয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই কথায় আমি বিস্মিত।’’ 

বললেন ‘নারায়ণ’। আসল নাম মধুসূদন মণ্ডল। নন্দীগ্রামে ২০০৭-এ প্রথম যে মাওবাদী পা রেখেছিলেন তেরপেখিয়া দিয়ে, নদী পেরিয়ে তিনিই মধুসূদন। পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলায় ধরা পড়েন। নাশকতায় অভিযুক্ত হিসাবে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। সম্প্রতি জামিনে বাইরে আছেন। জামিনে থাকা অবস্থায় তৃণমূল যাতে জিততে পারে সেই ভাবে প্রচার চালাচ্ছেন। সোমবার বললেন, ‘‘আমরা এমন চারজন মিলে একটি গোষ্ঠী গড়েছিলাম। কিন্তু বাকিদের সঙ্গে ঠিকমত যোগাযোগ হচ্ছে না। তাই আমি একাই প্রচার করছি আমার মত করে। আমাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মসূচি হয়। সেই যোগাযোগের ভিত্তিতে প্রচার চালাচ্ছি।’’ 

কী প্রচার? নারায়ণ বললেন,‘‘বিজেপিকে ভোট নয়। বিজেপিকে হারাতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী দলকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।’’ সেই শক্তি কে? নারায়ণ বললেন,‘‘তৃণমূলই মূল শত্রু বিজেপির। তাই সরাসরি না হলেও ওদেরই ভোট দিতে বলছি।’’

নন্দীগ্রাম-গবেষণাগারের ফর্মূলাই এখনও মেনে চলছেন ‘প্রাক্তন মাওবাদী’ সেই নারায়ণ। 

কিন্তু মমতা ব্যানার্জির রবিবার রেয়াপাড়ায় করা মন্তব্যে সেই ‘বিপ্লবী’-ও বিলকুল ঘাবড়ে গেছেন। এদিন তাই ‘আমি বিচারাধীন’ অজুহাত বাড়িয়ে দিলেন। 

মুখ্যমন্ত্রী সোমবার কিছুটা ম্যানেজের চেষ্টা করেছেন। এদিন খোদামবাড়ি থেকে বাঁদিকে সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ল তাঁর রোড শো। তিনি দু চাকার যানে। তাঁকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সামনে পিছনে শ’খানেক নিরাপত্তা রক্ষী। রাজ্য পুলিশ যেমন ছিল কলকাতা পুলিশের বাহিনীও গাড়ি সমেত হাজির। রিজওয়ানুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যুর পরে যাঁর ক্যারিয়ার প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল, সেই জ্ঞানবন্ত সিং তৃণমূল নেত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে। তাঁর ঘাম ছুটে যাচ্ছে। সামনে পিছনে মেরেকেটে পাঁচশো তৃণমূল কর্মী। কলকাতা থেকে মমতা ব্যানার্জি বিলি করার জন্য দেদার টুপি, ছাতা এনেছেন। গ্রামের মধ্যে অকাতরে তা বিলি হলো। টুপিতে নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থীর ছবি। আর স্লোগান- বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়। মমতা ব্যানার্জির সেই পাঁচশো কর্মী আর দেড়শো পুলিশের রোড শো তখন রেয়াপাড়ার খালপাড়ে উঠে ডান দিক নিয়েছে। দুই গ্রামবাসী পোলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পাড়ার এক শশব্যস্ত মাঝবয়সি তৃণমূল কর্মীর হাত টেনে ধরে একজন বললেন, ‘‘হ্যাঁ রে, নিজের মেয়ে বাড়িতে এলে টুপি নিয়ে আসে কবে থেকে?’’ 

হাত ছাড়িয়ে সেই মাঝবয়সি তৃণমূল কর্মী প্রথমে একটি খিস্তি দিলেন। তারপর ছুটলেন। খালের ওপারে তখন ব্যান্ড বাজছে। হাতে মাইক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ভোট চাইছেন। নমস্কার করছেন। নিজের নাম ইভিএম’র কত নম্বরে আছে, তা শোনাচ্ছেন। 

রাজ্যর ২৯৪টি কেন্দ্রে যিনি দলের প্রার্থী, তিনি একটি কেন্দ্রের পথে পথে ঘুরছেন ভোটের জন্য— স্বঘোষিত ‘অগ্নিকন্যা’ শেষ কবে এমন করেছেন? মমতা ব্যানার্জির দীর্ঘদিনের সঙ্গী শিশির অধিকারী বললেন, ‘‘সম্ভবত অন্য এক প্রার্থীর জন্য ২০০১-এ জগদ্দলে উনি এমন করেছিলেন। আর কখনো করেননি। এর বাইরে আমার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।’’

রোড শো’র পরে ঠাকুরচকে সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী। ছাউনির নিচে শ’তিনেক লোক। সেখানেই মুখ্যমন্ত্রী রবিবারের বক্তব্য থেকে পিছু হটলেন। তিনি রবিবার বলেছিলেন,‘‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পুলিশের পোশাক পরে অনেকে গুলি চালিয়েছিল। হাওয়াই চটি পরে এসেছিল। এবারেও সেসব কেলেঙ্কারি করছে। এই বাপ-ব্যাটার পারমিশান ছাড়া সেদিন পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি।’’ 

সোমবার বললেন, ‘‘ওরা (মানে বাপ-ব্যাটা, অর্থাৎ শিশির এবং শুভেন্দু অধিকারী) পুলিশকে ডেকে এনেছিল। সিপিএম’র ক্যাডাররা পুলিশের পোশাক পরে এসেছিল।’’

মানে দাঁড়ালো, তৃণমূলের দুই নেতা বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে পুলিশ ডেকে গ্রামবাসীদের খুন করতে চেয়েছিল। যাতে তৃণমূলের এবং মমতা ব্যানার্জির সুবিধা হয়। এবং সিপিআই(এম)’র কর্মীরা মমতা ব্যানার্জিকে মুখ্যমন্ত্রী করতে অধিকারীদের দেওয়া পুলিশের পোশাক এবং হাওয়াই চটি পরে গ্রামবাসীদের খুন করতে হাজির হয়েছিলেন। 

‘‘খুব জটিল হিসাব। আমার মাথায় ঢুকছে না উনি কী বলতে চাইছেন।’’ বললেন গোকুলনগরের স্বদেশ দাস অধিকারী। ২০০৭-র জানুয়ারি থেকে নন্দীগ্রামে এলাকা দখলের অন্যতম কারিগর দাস অধিকারী এখনও নন্দীগ্রাম-১ নং পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ। ঠিক কী হয়েছিল সেটা নানা কথার মারপ্যাঁচে এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু সোমবার মমতা ব্যানার্জি যেটা বলেছেন, সেটা কিছুতেই হয়নি, এ কথা হলফ করে বললেন। তাঁর কথায়, ‘‘খেজুরির হিমাংশু দাস শুভেন্দু অধিকারীর কথায় নিজের লোকজনকে পুলিশের পোশাক পরিয়ে গুলি চালাতে পাঠাবে, এ কথা শুধু তিনি ভাবতে পারেন যিনি এই এলাকার কিছুই জানেন না। মানুষ এসব বিশ্বাস করছে না।’’ 

মানুষ কী বলছেন? 

মানুষ চুপ। তবে তৃণমূল নেতা, নন্দীগ্রাম-১নং ব্লকের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ অজয় মণ্ডলের কাছে মিলল আশ্চর্য সুর। সোনাচূড়ার এই তৃণমূল নেতা বললেন,‘‘মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন রবিবার তা নিয়ে আমাদের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। উনি যেটা বলেছেন, অর্থাৎ শুভেন্দুবাবুই লোক পাঠিয়ে মানুষ মেরেছেন। তা হতে পারে। কারণ আমরা জানি শুভেন্দুবাবু লাশের রাজনীতি করেন।’’ মমতা ব্যানার্জি তা জানতেন। কিন্তু এতদিন এতগুলি মানুষের খুনের সত্য শুধু মুখ্যমন্ত্রী থাকার জন্য চেপে রেখেছেন? এ কি ভয়ঙ্কর অন্যায় নয়? এবার সরে গেলেন শিক্ষক অজয় মণ্ডল। চলে গেলেন অন্য প্রসঙ্গে। বললেন,‘‘বামেদের প্রার্থী খুব ভালো হয়েছে। আমার ছেলে যাদবপুরে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ও বলে, বাবা বামপন্থীদের মধ্যে ভালো ভালো ছেলে উঠে আসছে। মীনাক্ষীর বক্তৃতা আমরা শুনেছি। খুব ভালো। নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর টাকার সঙ্গে পারবে না। অন্য যে কোন জায়গায় হলে জিতে যেত। চমৎকার মেয়ে।’’

শুভেন্দুর টাকার সাথে পারবে না? তাহলে কি মমতা ব্যানার্জি লড়াইয়ে নেই? অনেকটা পিছিয়ে গেছেন? লড়াই কি বিজেপি বনাম সংযুক্ত মোর্চার? 

অজয় মণ্ডলের কথা কানে বাজলো। সাংবাদিক সত্তা কিঞ্চিৎ সরিয়ে বলে ফেললাম,‘‘পারলে আপনিও ওকে ভোট দেবেন। ছেলেকে বলবেন দিতে।’’ দলের দুর্নীতি, অত্যাচার, সুফিয়ানের জাহাজ বাড়ি আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিধ্বস্ত অজয় মণ্ডল হা হা করে হেসে উঠলেন। 

প্রশ্রয়ের হাসি। 

টোটোর প্রচারে নন্দীগ্রামের হৃদয় ছুঁয়ে ফেলেছে ‘সিপিএমের’ এক খরস্রোতা মেয়ে। তাই এক প্রৌঢ়াকে হাত জড়ো করে হুইলচেয়ারে রাস্তায় নামতে হয়েছে। ভর দুপুরে। ভোটের জন্য। 

মমতা হেরে গেছেন। 

নন্দীগ্রাম দেখছে।

কিন্তু ভোটের দিন অবাধ ভোট করতে হবে। সবাই যাতে ভোট দিতে পারেন, আগের দিন তাদের যেন কেউ হুমকি না দেয়— এই বিষয়গুলিতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম)। এদিন নন্দীগ্রাম-১নং এরিয়া কমিটির কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পার্টি নেতা রবীন দেব, পার্টির জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি এবং প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জি বলেছেন, নন্দীগ্রামের মানুষ দশ বছর ভোট দিতে পারেননি। এবার তার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা মানুষ বিক্ষুব্ধ। মমতা ব্যানার্জির ১৪ মার্চ সংক্রান্ত নতুন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দাবি, আসল সত্য প্রকাশ করা হোক। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জি এবং শুভেন্দু অধিকারী মিলেই চক্রান্ত করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই তা স্পষ্ট। 

================= 

রবিবার মমতা: 

 ‘‘আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পুলিশের পোশাক পরে অনেকে গুলি চালিয়েছিল। হাওয়াই চটি পরে এসেছিল। এবারেও সেসব কেলেঙ্কারি করছে। এই বাপ-ব্যাটার পারমিশান ছাড়া সেদিন পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি।’’ 

সোমবার মমতা 

 ‘‘ওরা (শিশির এবং শুভেন্দু অধিকারী) পুলিশকে ডেকে এনেছিল। সিপিএম-র ক্যাডাররা পুলিশের পোশাক পরে এসেছিল।’’

Source- Ganashakti